বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দাও । বাংলাদেশের জনগণের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বিশ্লেষণ কর

পৃথিবীতে নানা ধরনের জনগোষ্ঠী বাস করে। এসব জনগোষ্ঠীর মানুষের রয়েছে নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। বাঙালি জাতি গঠনগতভাবে মিশ্র বা সংকর জাতি। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে। বাঙালি জাতি গঠনে যেসব জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আদি অস্ট্রেলীয়, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, তুর্কি-ইরানীয়, ইন্দো-আর্য, মোঙ্গলীয়, আলপীয় নরগোষ্ঠী ইত্যাদি। এসব জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বাঙালি জাতি তৈরি হয়েছে এবং বর্তমান রূপ লাভ করেছে ।

বাংলাদেশের জনগণের/বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়: 

বাংলাদেশের জনগণের বা বাঙালি জাতির পরিচয় নিয়ে নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলেই একমত যে, বাঙালি জাতি হলো একটি সংকর জাতি। নিম্নে বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আলোচনা করা হলো :

১. তুর্কি-ইরানীয়: 

বাঙালি জাতির গঠনে তুর্কি-ইরানীয় জাতির প্রভাব রয়েছে। তুর্কি-ইরানিরা হলো এ অঞ্চলের প্রথম শ্রেণির মানবগোষ্ঠী। তাই বাঙালিদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তুর্কি- ইরানিদের প্রভাব বিদ্যমান। এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘ দেহ, সংকীর্ণ ও দীর্ঘ মাথা, গায়ের রং হালকা বাদামি থেকে গোলাপি শুভ্র এবং কালো ধূসর বর্ণের মিশ্ৰিত চোখ। বালুচ ব্রাহুই, পাঠান প্রভৃতি জাতি এ শ্রেণির নরগোষ্ঠীভুক্ত ।

২. ইন্দো-আর্য: 

বাঙালি জাতি ইন্দো-আর্য জাতির মিশ্রণে তৈরি হয়েছে। প্রাচীনকালে এ জাতিগোষ্ঠী কাশ্মীর, রাজস্থান, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে বসবাস করতো। এ নরগোষ্ঠী শ্রেণির বৈশিষ্ট্য হলো এদের দেহ দীর্ঘ, নাকের আকার সংকীর্ণ ও দীর্ঘ, শিরাকার দীর্ঘ, গায়ের রং ফর্সা এবং চোখ, কান ও মুখমণ্ডলে দাড়ি ও গোঁফের বাহুল্য । অনেক বাঙালি এ জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। 

৩. শক-দ্রাবিড়ীয়: 

প্রাচীনকালে পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চলে যে জাতিগোষ্ঠী বাস করতো তারা শক-দ্রাবিড়ীয় নামে পরিচিত। এ শ্রেণির মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো এদের গায়ের রং বাদামি থেকে ফর্সা, দৈহিক কাঠামো মধ্যমাকৃতির, বিস্তৃত মাথা এবং নাকের আকার মধ্যম প্রকৃতির। বাঙালিদের মধ্যে গুজরাটি ব্রাহ্মণ, কুন্বি ও কুর্গ এবং মারাঠি ব্রাহ্মণ জাতের লোকেরা এ শ্রেণির মানুষের অন্তর্ভুক্ত।

৪. আর্য-দ্রাবিড়ীয়: 

বাঙালিদের মধ্যে আর্য-দ্রাবিড়ীয়দের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আগ্রা, অযোধ্যা, পূর্ব পাঞ্জাব ও রাজস্থানের কিছু অঞ্চল ও বিহার প্রদেশে এ শ্রেণির মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। এ শ্রেণির মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো এদের দৈহিক আকার মধ্যমাকৃতির, দীর্ঘ শিরাকা এবং নাসাকৃতি মধ্যম ।

৫. মোঙ্গলীয়: 

বাঙালি জাতি মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। বিশেষ করে চীনের হোয়াংহো অঞ্চলের মোঙ্গলীয় ধারা উপমহাদেশের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। মোঙ্গলীয়দের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো এদের গায়ের রং পীতবর্ণের, চোখ ক্ষুদ্রাকৃতির, চোয়ালের হাড় উঁচু ইত্যাদি। হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা, নেপাল, ভুটান, আসাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে মোঙ্গলীয়দের প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের ৮৪.৩ শতাংশ এবং খাসিয়াদের ৭৮ শতাংশ মানুষ মোঙ্গলীয় প্রভাবে গঠিত ।

৬. দ্রাবিড়ীয়: 

বাঙালি জাতি গঠনে দ্রাবিড়ীয়দের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দ্রাবিড়রাই হলো ভারতবর্ষের আদিম ও প্রাচীনতম জাতি। এ শ্রেণির মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো এদের গায়ের রং বাদামি থেকে ঘন কালো, দীর্ঘ শিরাকার, ক্ষুদ্রাকৃতির দেহ, প্রশস্ত নাসিকা ইত্যাদি। সিংহলের ভেড্ডা, দক্ষিণ ভারতের পনি, মধ্য ভারতের কোল, কাদির, ভীল, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী দ্রাবিড়দের সার্থক প্রতিনিধি ।

৭. আর্য আদি বংশ: 

আর্য আদি বংশ থেকে বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে । প্রাচীনকালে আর্যরা দ্রাবিড় ও ভেড্ডিডদের পরাজিত করে এ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আর্যরা বহুকাল যাবৎ এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এ শ্রেণির মানুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো দেহের বলিষ্ঠ গড়ন, লম্বা মাথা, সরু ও লম্বা নাক ইত্যাদি। উত্তর ভারত, পাঞ্জাব ও রাজপুতনায় এ শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়।

৮. দ্রাবিড় মুণ্ডাগোষ্ঠী: 

ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিদের মধ্যে দ্রাবিড় মুণ্ডাগোষ্ঠীর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ শ্রেণির মানুষ দ্বিতীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

৯. আলপীয় নরগোষ্ঠী: 

আলপীয় নরগোষ্ঠীর মানুষেরা পামির মালভূমি থেকে এসে এদেশে বসবাস করা শুরু করে । নৃবিজ্ঞানীদের মতে, এ শ্রেণির মানুষ বহিরাগত এবং এরা নভিক শ্রেণিভুক্ত নয়। এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলো মাথা গোলাকার, মুখ গোঁফ দাড়িতে ভরা ও সরু নাক। এদেশের ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও কিছু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে আলপীয়দের প্রভাব লক্ষ করা যায়। 

১০. মুসলিম প্রভাব বিশিষ্ট জাতি: 

নবম শতকে এদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হলে এদেশে অনেক তুর্কি, আফগান, মুঘল, আরবি ও ইরানিদের আগমন ঘটে। তারা ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করলেও তাদের অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যান। স্বাভাবিকভাবেই উক্ত মুসলমানদের প্রভাব এদেশের মানুষের মধ্যে পড়েছে। এছাড়াও অনেক মুসলমান ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ এদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যান। বিবাহের মাধ্যমে তাদের সাথে বাঙালি জাতির সংমিশ্রণ ঘটে যা বাঙালি জাতি উৎপত্তিতে অবদান রাখে

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এদেশের মানুষ হলো সংকর প্রজাতির মানুষ । এদেশে অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের জন্য আসে এবং এদের কেউ কেউ স্বদেশে ফিরে গেলেও তাদের অনেকেই এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই এসব মানুষের প্রভাব বাঙালিদের ওপর পড়েছে। তাই নৃবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, বাঙালি জাতি হলো একটি সংকর জাতি।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url