বাংলা নামের উৎপত্তি - বাংলা নামের উৎপত্তি কীভাবে হলো - বাংলা নামের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ

বাংলা বা বঙ্গ নামের উৎপত্তি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে আমরা বাংলা নামের উৎপত্তির বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাই। বাংলা কখনও 'বেঙ্গল' কখনও ‘বেঙ্গালা' আবার 'বোঙ্গালা' ও 'বাঙ্গালাহ' ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। 'বেঙ্গালা শহরের অবস্থিতি সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও ‘বেঙ্গালা' রাজ্য যে বাংলাদেশ অঞ্চলকে বুঝাতো সে বিষয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই ।

বাংলা বা বঙ্গ নামের উৎপত্তি: বাংলা বা বঙ্গ নামের উৎপত্তি কীভাবে, কখন হলো তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে । নিম্নে এসব তুলে ধরা হলো :

১. প্রাচীন মতবাদ: বঙ্গ নামের উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীনকালেই । খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বঙ্গ ছিল বিভিন্ন জনপদের সমষ্টির নাম । ‘ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থে প্রথম বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া মহাভারতেও বঙ্গ নামের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে এ বঙ্গকে ভৌগোলিক ইউনিট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

২. আবুল ফজলের দৃষ্টিতে বাংলা: আবুল ফজল ‘বাঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বলেন, 'বাঙ্গালাহ'র আদি নাম ছিল 'বঙ্গ'। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্রকাণ্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন; এ থেকেই 'বাঙ্গাল' বা 'বাঙ্গালাহ' নামের উৎপত্তি। অবশ্য আবুল ফজলের এ ব্যাখ্যা সবাই স্বীকার করে নেননি ।

৩. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে বঙ্গ: রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, প্রাচীনকাল হতে 'বঙ্গ' ও 'বঙ্গাল' দুটি পৃথক দেশ ছিল । 'বঙ্গাল' দেশের নাম হতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের 'বাংলা' নামকরণ হয়েছে। বর্তমানকালে বাংলাদেশের অধিবাসীদেরকে যে 'বাঙ্গাল' নামে অভিহিত করা হয়, তা সেই প্রাচীন 'বঙ্গাল' দেশের স্মৃতিই বহন করছে ।

৪. নীহাররঞ্জন রায়ের মতামত: নীহাররঞ্জন রায় আবুল ফজলের মতের সাথে মিলিয়ে বলেন, নদীমাতৃক দেশে বন্যা ও জোয়ারের স্রোত রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (আল) নির্মাণ কৃষি ও বাস্তুভূমির জন্য অনিবার্য ছিল। আর 'বঙ্গ' এর সাথে ‘আল’ যুক্ত হয়ে 'বাঙ্গালা' নামকরণ হয়েছে ।

৫. মিনহাজ ই সিরাজ ও শামস ই সিরাজ আফিফের মতে বাংলা: ঐতিহাসিক মিনহাজ ই সিরাজ লখনৌতি ও বঙ্গকে পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন এবং যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব বাংলাকে বুঝিয়েছেন। মিনহাজের পরবর্তী জিয়াউদ্দিন বারানি সর্বপ্রথম 'বাঙ্গালা' শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু তিনি সমগ্র দেশ নয় বরং এর অংশবিশেষের উল্লেখ প্রসঙ্গে শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তী ঐতিহাসিক শামস ই সিরাজ আফিফ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে ‘শাহ ই বাঙ্গালা' রূপে আখ্যা দিয়েছেন। ইলিয়াস শাহ বাংলায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন। তাই তাঁর সময় থেকেই ‘বাঙ্গালা' নামের প্রচলন হয় ।

৬. সুকুমার সেনের মতে বাংলা: সুকুমার সেন এর মতে,“বঙ্গ” থেকে 'বাঙ্গালা বা 'বাঙ্গালাহ'র উৎপত্তি হয়েছে। 'বাঙ্গালা' নামটি মুসলমান অধিকার কালে সৃষ্ট এবং ফারসি 'বাঙ্গালাহ' থেকে পর্তুগিজ ‘বেঙ্গালা' ও ইংরেজি 'বেঙ্গল' এসেছে বলে মত প্রকাশ করেন । 

৭. ভ্রমণকারীদের লেখনীতে বাংলা: ইংরেজ শাসনকালে বাংলা 'বেঙ্গল' (Bengal) নামে পরিচিত ছিল। ষোলো ও সতেরো শতকে ইউরোপীয়দের লেখনীতে 'বেঙ্গালা' নামে দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। মার্কো পোলো 'বেঙ্গালা' শহরের উল্লেখ করেছেন। গ্যাস্টলদি তাঁর মানচিত্রে চাটিগ্রামের পশ্চিমে 'বেঙ্গালার' অবস্থিতি দেখিয়েছেন। 

পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি আমরা একাধিক সূত্র থেকে পাই। আবুল ফজল ও নীহাররঞ্জন রায়ের মতামত অনেকটা একই রকম হলেও রমেশচন্দ্র মজুমদার আবার ভিন্ন মত পোষণ করেন। শামস ই সিরাজ আফিফ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে ‘শাহ ই বাঙ্গালা' নামে অভিহিত করেন। এ সময় ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলার একচ্ছত্র অধিপতি হন এবং তাঁর সময় থেকেই বাঙ্গালা' নামের প্রচলন হয় যা ক্রমে 'বাংলা' রূপ নেয় ।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url