রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় অনুভূতি নিখিলের সর্বত্র
পরিব্যাপ্ত । তিনি অত্যন্ত উদ্বগের সাথে লক্ষ করেন, ইংরেজ শোষণের শিকার ভারতীয়
উপমহাদেশ একসময় শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যসহ মৌলিক বিষয়গুলো থেকে বঞ্চিত হয়।
অন্যদিকে, ইউরোপে এ ইংরেজরা বিত্তবৈভবে, আবিষ্কারে, বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বিষয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হন। তাই লেখক ‘সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধে
ভারতবাসীর দুর্দশার বর্ণনা করে নিজের মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
পরিবার ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবর্ষের এক বনেদি পরিবার। এ পরিবারের
প্রায় সবাই ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রচণ্ড অনুরাগী। এর ফলে
শৈশব থেকে তিনি ইংরেজ সভ্যতার সংস্পর্শে অনুরাগী হয়ে পড়েন এবং স্বাভাবিক অনুরাগে
ইংরেজকে হৃদয়ের উচ্চাসনে স্থান দেন। কিন্তু তিনি জীবনের প্রথম ভাগে পরিচিত
ইংরেজদের সাথে শেষ ভাগের ইংরেজদের চরিত্রের মিল খুঁজে পাননি। জীবনের শেষ ভাগে তিনি
প্রত্যক্ষ করেন ইংরেজদের আদর্শচ্যুতি, যা তাকে কঠিন মর্মবেদনায় নিপতিত করে। তিনি
দেখতে পান যে ইংরেজরা সভ্যতাকে চরিত্রের উৎসমূল থেকে উৎসারিত বলে স্বীকার করেন,
সেই ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থে তাকে অনায়াসে অপব্যবহার ও লঙ্ঘন করছে। ইংরেজদের
মানবমৈত্রীর যে বিশুদ্ধ পরিচয় দৃশ্যমান তা আসলে এক কলঙ্কিত বাহ্যরূপ ।
রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেন ইংরেজদের স্বার্থবাদী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকলে
কীভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে অসহায় ভারতীয় জনসাধারণ। তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও আগ্রাসী
শাসন-শোষণে গোটা ভারতবর্ষের মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। নিভৃত সাহিত্যচর্চার আবেষ্টন
হতে বের হয়ে রবীন্দ্রনাথ চোখের সামনে যা প্রত্যক্ষ করেন তা হৃদয়বিদারক । তিনি
দেখতে পান ইংরেজদের সীমাহীন লুণ্ঠনে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্যে
জর্জরিত, ভারতের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সারা ভারতবর্ষে দেখা.
দিয়েছে দুর্ভিক্ষ । অন্ন, বস্ত্র, পানীয়, শিক্ষা, আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের
শরীর-মনের পক্ষে যা কিছু অত্যাবশ্যক তার এমন নিরতিশয় অভাববোধ হয় পৃথিবীর আধুনিক
শাসনচালিত কোনো দেশেই তিনি দেখতে পাননি। ইংরেজরা ভারতবর্ষের জনসাধারণকে এরূপ
দুর্গতিতে ফেলেছে অথচ এদেশ ইংরেজকে দীর্ঘকাল ধরে ঐশ্বর্য জুগিয়ে এসেছে। এ ইংরেজ
শাসনের রূপ ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা দেখে প্রাবন্ধিক মর্মবেদনায় মর্মাহত হন ।
উপসংহার : রবীন্দ্রনাথের এক ইংরেজ বন্ধু
জনহিতৈষী ও সমাজসেবক লিওনার্দ ইম্পহাস্ট, যিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভারতের পল্লি
উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, তাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, 'লাখ লাখ মানুষের ভাগ্যান্বেষণে
পরাজিতমনা ব্যক্তিদের ন্যায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করার দরকার নেই। এসব মানুষের সহজাত
সংস্কৃতি ও শান্তিপূর্ণ ঐতিহ্য যুগপৎভাবে তাদের ক্ষুধা, রোগব্যাধি, দেশি-বিদেশি
শোষণ এবং বিক্ষুব্ধ ও অসন্তোষমূলক সাম্প্রদায়িকতার অধীন করে দিচ্ছে।'