উনিশ
শতকের বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন একটি অসাধারণ প্রতিভার নাম। সে সময়ে আর কোনো
মুসলিম লেখক বাংলা গদ্যচর্চায় এগিয়ে আসেন নি। তিনি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অবদান
রেখেছেন। উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী প্রভৃতি সৃজনশীল সাহিত্য তিনি রচনা
করেছেন। তাঁর রচিত 'বিষাদ সিন্ধু' ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ উপন্যাস লিখেই মীর মশাররফ হোসেন
সুনাম অর্জন করেন। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা' আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, ‘আমার জীবনী’ ও
'বিবি কুলসুম' লেখকের আত্মজীবনীমূলক রচনা। এসব গ্রন্থে মীর সাহেবের যে পরিচয় পাওয়া
যায় তাতে তাঁর বহুমুখী সাহিত্য সৃষ্টির প্রশংসাই করতে হয়। একমাত্র ‘গাজী মিয়ার বস্তানী'
গ্রন্থে ভিন্নতর রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। গ্রন্থটি সামাজিক প্রেক্ষাপটের অভিজ্ঞতাবদ্ধ
ঘটনার নানা বিবরণে পূর্ণ। ‘বস্তানী’কে অনেক সমালোচকই নকশা জাতীয় রচনা হিসেবে অভিহিত
করেছেন। এ গ্রন্থে কোনো দৃঢ় সংবদ্ধ কাহিনী নেই। কতকগুলো খণ্ডচিত্র লেখক এ গ্রন্থে
অঙ্কন করেছেন।
গ্রন্থটির
গঠন কৌশলও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ভাষাও সহজ আর চরিত্রগুলো অনেকটা
মন্থর। কেউ কেউ এ গ্রন্থকে শিথিলবদ্ধ উপন্যাস বলেছেন; কেউ বলেছেন সামাজিক নকশা। বাংলা
সাহিত্যে এর আগে অসংখ্য সামাজিক নকশা রচিত হয়েছে, যেমন- নববাবু বিলাস, নববিবি বিলাস,
কলিকাতা কমলালয়, আলালের ঘরের দুলাল ইত্যাদি। এসব রচনায় তৎকালীন সামাজিক চিত্র যা
বাস্তবে পরিলক্ষিত হতো তাই অঙ্কিত হয়েছে। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী'তেও তাই। উপন্যাসের
কিছু কিছু লক্ষণ এসব রচনায় থাকলেও প্রকৃত অর্থে এগুলোকে উপন্যাস বলা যায় না।
মীর
মশাররফ হোসেন সমাজ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, আর বঙ্কিমচন্দ্রের মত তিনি ছিলেন নীতিবাদী
লেখক। পাপের পরাজয় ও পুণ্যের জয় ঘোষণায় তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের
ভিতর দিয়ে তিনি চরিত্রের ব্যাখ্যা করেন নি, যা দেখেছেন তাই লিখেছেন। যেমনটি ঘটেছে
তেমনটির ছবি অঙ্কন করেছেন। বাস্তব ঘটনাকে জীবনরসে জারিত করে নতুনরূপে প্রকাশ করার প্রবণতা
তাঁর লেখায় লক্ষ্য করা যায় না। বাস্তব ঘটনাই যথার্থ শিল্পীর হাতে এক অভিনব আবেদনে
পাঠকচিত্তকে রসাপ্লুত করে । বাস্তবের হুবহু বর্ণনা চিত্র ছাড়া আর কিছু নয় । ‘গাজী
মিয়ার বস্তানী' চিত্র বা নকশা জাতীয় রচনা বলেই অধিকাংশ সমালোচক মন্তব্য করেছেন। তবে
কেউ কেউ এ গ্রন্থকে মীরের শ্রেষ্ঠ রচনা বলেও অভিমত দিয়েছেন। এ অভিমত যথার্থ বলে আমরা
মনে করি না। কারণ এ গ্রন্থে পাত্রপাত্রীর সংখ্যা পঞ্চাশের মতো। এদের অনেকেই গ্রন্থের
কাহিনীর জন্য অবাঞ্ছিত। মূল ঘটনার পরিণতিতে এদের কোনো অবদান নেই। এ ধরনের চরিত্র চিত্রণ
শুধু সামাজিক নকশা জাতীয় রচনায়ই দেখা যায় ।
‘গাজী
মিয়ার বস্তানী’তে তিনজন মুসলমান মহিলা জমিদারের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। লেখক ছদ্মনামে
এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থে দু'টি কাহিনী স্থান পেয়েছে। একটি পয়জারুন্নেসার কাহিনী।
অন্যটি সোনাবিবি ও মতিবিবির সংঘর্ষের কাহিনী। দু'কাহিনীর পরিণতি দু'দিকে। উপন্যাসের
মৌলিক চরিত্র এখানে ক্ষুণ্ন হয়েছে। লেখক গ্রন্থে যেসব চরিত্র স্থান দিয়েছেন তারা
সমাজেরই মানুষ। তাদের আসল নাম ঢাকা পড়েছে ছদ্মনামের অন্তরালে। লেখক যেসব নাম ব্যবহার
করেছেন তা চরিত্রের মূল পরিচয়কে বা স্বভাবকে ফুটিয়ে তুলেছে। সেজন্য নামগুলো তাৎপর্যবাহী।
ভেড়াকান্ত, দাগাদারী, জয়ঢাক, সবলোট চৌধুরী, মাথা পাগলা রায় ইত্যাদি নাম ব্যবহারে
লেখক রসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। স্থানের নামগুলোও তাৎপর্যবাহী; যেমন- অরাজকপুর, যমদ্বার,
নচ্ছারপুর, নেংটিচোরা ইত্যাদি ।
‘গাজী
মিয়ার বস্তানী' সামাজিক চিত্র সংবলিত উপন্যাস। উপন্যাসে মূল দাবি অখণ্ড কাহিনী নির্মাণ।
লেখক এ গ্রন্থে কোনো অখণ্ড কাহিনীর ক্রম পরিণতির চিত্র অঙ্কন করতে পারেন নি। গ্রন্থে
সৎ ও অসৎ দু'রকম চরিত্র আছে। সৎ অসৎ মিলিয়ে যে দ্বন্দ্বময় মানব চরিত্র তা এ উপন্যাসে
নেই। কোনো চরিত্রেরই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নেই। অনেক ঘটনারই কার্যকারণ সম্বন্ধে কোনো
হদিস পাওয়া যায় না। ভেড়াকান্ত সৎ, এর সততার প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ গ্রন্থে নেই।
লেখক চিত্ৰ এঁকেছেন জমিদার শ্রেণীর কার্যকলাপের উপর ভিত্তি করে।
‘গাজী
মিয়ার বস্তানী'তে অসংগতি আছে, অতিকথন আছে, অসামাজিক ঘটনার অবতারণা আছে। চরিত্রগুলো
ছবির মতো। কোনো চরিত্রেই দ্বন্দ্ব নেই, সরলরেখায় সমর্পিত-ভালো খুবই ভালো, মন্দ খুবই
মন্দ। পুণ্যের জয় ও পাপের পরাজয় দেখানোই লেখকের উদ্দেশ্য। এদিক থেকে ‘গাজী মিয়া'
একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রচনা। লেখকের ব্যক্তিজীবনের ঘটনার সাথে এর যোগ আছে বলেই মনে
হয়। তবে সমাজের ক্লেদ, গ্লানি, স্বার্থপরতা ইত্যাদির চিত্র অকপট বর্ণনায় লেখক ফুটিয়ে
তুলেছেন। এ গ্রন্থে সমসাময়িককালের একটি বিশ্বস্ত চিত্র পাওয়া যায় ।
‘গাজী
মিয়ার বস্তানী' সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেছেন,
“গ্রন্থটির গঠন রীতি বহুদিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ। এর কাঠামোটি শিথিল এবং এক ঘটনা থেকে
অন্য ঘটনার কাহিনীর উত্তরণ অত্যন্ত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। এতে অনেক অপ্রাসঙ্গিক চরিত্র সন্নিবেশিত
করা হয়েছে। এসব চরিত্রের অনেকগুলো বর্জন করলেও কোনো ক্ষতি হতো না। অনেক বক্তৃতা, অনেক
উক্তি, মন্তব্য এবং স্থানে স্থানে বর্ণনা এত দীর্ঘ যে, তা অনেক সময় বিরক্তি উৎপাদন
করে এবং বৈচিত্র্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট
যে, প্রয়োজনীয় মূল কাহিনীতে সংহতির অভাব রয়েছে।”
কোনো
কোনো সমালোচক মন্তব্য করেছেন, ‘মীর মশাররফ হেসেন নকশাকার-শিল্পী নন।' এই মন্তব্য স্বীকার
করা যায় না। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী' সম্পর্কে এ মন্তব্য আংশিক সত্য। এ গ্রন্থে তিনি
নকশাকার। কিন্তু নকশাও এক ধরনের শিল্প। কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডীতে শিল্পীকে বন্দি করা
যায় না। শিল্পী বিচিত্র উপায়ে তাঁর ভাবনাকে রূপ দিতে পারেন। নির্দিষ্ট নিয়মের বেড়ি
সাহিত্যের বেলায় সর্বত্র প্রযোজ্য নয়। উপরন্তু, মশাররফ হোসেনের অন্যান্য রচনা যেমন— 'বিষাদ
সিন্ধু', ‘আমার জীবনী' ইত্যাদিকে কোনোমতেই নকশা জাতীয় রচনা বলা যায় না। 'বিষাদ সিন্ধু'
লিখেই মশাররফ হোসেন খ্যাতি অর্জন করেছেন, শিল্পী হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। কোনো একটি
রচনার উপর নির্ভর করে সমগ্র শিল্পীসত্তার বিচার করা যায় না। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী'
পড়েই যদি মশাররফ হোসেনের প্রতিভার মূল্যায়ন করা হয় তাহলে শিল্পীর প্রতি অবিচার করা
হয়। আসলে বাংলা গদ্য সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন একজন দক্ষ শিল্পী-‘বিষাদ সিন্ধু' এর
পরিচয় বহন করে। মশাররফ হোসেন বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তিনি যেমন ঐতিহাসিক উপন্যাস
ও আত্মজীবনী লিখেছেন, তেমনি সামাজিক নকশাও এঁকেছেন। তাই বলে তাঁকে শিল্পীর আসন থেকে
নামিয়ে নকশাকার হিসেবে চিহ্নিত করা কোনমতেই সমীচীন নয় ।
মীর
মশাররফ হোসেন সমাজ সচেতন শিল্পী ছিলেন। সমাজের বিভিন্ন ধরনের চিত্রই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন
তাঁর লেখায়। সে যুগের শিক্ষাব্যবস্থা, মুসলমান জমিদারদের জীবন প্রণালী, সমাজে নারীর
অবস্থা, সে যুগের সংস্কার, বিশ্বাস, হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক দুর্নীতি
ইত্যাদি তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী' সমাজচিত্র হিসেবে শুধু তথ্য
সরবরাহকারীই নয়, সেসব তথ্য সরল ভাষায়, আকর্ষণীয় করে, সুরসাল করে লেখক বর্ণনা করেছেন।
লেখকের বর্ণনাগুণে রচনা সরস ও প্রাণবন্ত হয়েছে। নকশা জাতীয় রচনাও শিল্প সার্থক রচনার
মর্যাদা পেয়েছে ।