মাইকেল
মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে নতুন নতুন শৈলী ও বিষয়বস্তুর সংযোজনের জন্য পরিচিত।
'বীরাঙ্গনা' কাব্যে তিনি মহাকাব্যিক চরিত্রগুলোর নারী-মানসের গভীরতা তুলে ধরেছেন।
এখানে মূলত মহাভারত ও রামায়ণের নারী চরিত্রদের মাধ্যমে তিনি সমাজ, প্রেম, বঞ্চনা,
সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
'বীরাঙ্গনা'
কাব্যটি ১১টি পদ্যরূপী চিঠির সংকলন। এই চিঠিগুলো মহাভারত ও রামায়ণের নারীদের
জবানিতে রচিত, যারা নিজেদের প্রেম, বেদনা, হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এখানে
প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্র কণ্ঠে কথা বলে, যা পাঠককে তাদের মনের গভীরে প্রবেশ করায়।
১.
দ্রৌপদী → অর্জুনের
প্রতি ক্ষোভ ও অভিমানের প্রকাশ।
২. সীতার চিঠি → রামের প্রতি
তার তীব্র অভিমান ও দুঃখের কথা।
3. শকুন্তলা → দুষ্মন্তের
প্রতি হতাশা ও প্রেমের ব্যথা।
4. যোজ্ঞসেনী (দ্রৌপদী) → স্বামীদের
দুর্বলতা ও নারীর প্রতি অবিচারের বর্ণনা।
5. অহল্যা → স্বামীর
নিদারুণ শাস্তি ও সমাজের রূঢ়তা নিয়ে আর্তনাদ।
6. সুর্পণখা → রামের প্রতি
ভালোবাসা ও লাঞ্ছনার বর্ণনা।
7. বিনতা → পুত্র গরুড়ের
প্রতি মায়ের আকুলতা।
8. মন্দোদরী → রাবণের পরাজয়
ও পতনের পর স্ত্রীর যন্ত্রণা।
9. উর্বশী → স্বর্গীয়
অপ্সরার ভালোবাসা ও বিচ্ছেদের অভিব্যক্তি।
10. দেবযানী → কচের প্রতি
অভিমান ও প্রতিশোধস্পৃহা।
11. গান্ধারী → ধৃতরাষ্ট্র ও
কৌরবদের পরাজয়ের পরে এক মাতৃহৃদয়ের যন্ত্রণা।
১.
নারীর আত্মমর্যাদা ও প্রতিকূলতার
বিরুদ্ধে অবস্থান
২. সমাজের দ্বিচারিতা ও নারীর
প্রতি অবিচার
৩. প্রেম, অভিমান ও প্রতারণার
করুণ চিত্র
৪. পৌরাণিক চরিত্রের মাধ্যমে
চিরকালীন মানবিক অনুভূতির প্রকাশ
'বীরাঙ্গনা'
কাব্য শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম নয়, এটি নারীর আত্মমর্যাদা, প্রেম, অবমাননা ও
সামাজিক বৈষম্যের এক অনবদ্য চিত্র। মহাভারত ও রামায়ণের নারীদের কণ্ঠস্বরকে তিনি এক
নতুন মাত্রা দিয়েছেন, যা বাংলা কাব্যধারায় এক উজ্জ্বল সংযোজন। এটি যুগে যুগে
পাঠকদের আবেগ স্পর্শ করে আসছে এবং বাংলা সাহিত্য জগতে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে টিকে
থাকবে।
মাইকেল
মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের অগ্রদূত। তাঁর রচনা শুধু বাংলা কবিতার
শৈলীকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং নতুন বিষয়বস্তুর সন্নিবেশ ঘটিয়ে সাহিত্যে বিপ্লব এনেছে।
তাঁর অন্যতম আলোচিত ও প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ ‘বীরাঙ্গনা’ (১৮৬২)। অনেকেই একে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি
বলে বিবেচনা করেন। তবে, এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কিনা, তা বিশ্লেষণের জন্য
আমাদের তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা
প্রয়োজন।
‘বীরাঙ্গনা’
কাব্যে প্রথাগত বর্ণনামূলক কবিতার পরিবর্তে চিঠির আকারে কবিতার বিন্যাস করা হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে এক
নতুন ধারা সংযোজন করেছে। এই নতুন শৈলী বাংলা কাব্যের বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছে।
প্রথাগত
মহাকাব্যে নারীরা সাধারণত গৌণ চরিত্র হিসেবেই চিত্রিত হয়েছেন। কিন্তু ‘বীরাঙ্গনা’
কাব্যে দ্রৌপদী, সীতা, শকুন্তলা, মন্দোদরী, অহল্যা প্রমুখ নারীচরিত্র তাঁদের
নিজস্ব অনুভূতি, বেদনা ও প্রতিবাদ ব্যক্ত করার সুযোগ পেয়েছে।
‘বীরাঙ্গনা’
কাব্যে মধুসূদনের অনবদ্য ছন্দ, চিত্রকল্প ও অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়েছে। ভাষা শৈল্পিক, হৃদয়গ্রাহী ও
সংবেদনশীল। এতে নাটকীয়তা ও আবেগপূর্ণ উপস্থাপনার মাধ্যমে পাঠক সহজেই চরিত্রগুলোর
মর্মযাতনা অনুভব করতে পারে।
এই
কাব্যে পৌরাণিক নারীদের প্রচলিত ‘আদর্শ’ ভাবনার বাইরে এনে তিনি তাদের মানবিক দুর্বলতা, অভিমান, প্রেম ও ক্ষোভের
গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। এই আধুনিক ব্যাখ্যার কারণে কাব্যটি চিরকালীন হয়ে উঠেছে।
মাইকেলের
শ্রেষ্ঠ রচনা নিয়ে বিতর্ক হলে প্রথমেই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’র প্রসঙ্গ উঠে আসে।
‘তিলোত্তমাসম্ভব’
কাব্যে তিনি পৌরাণিক কাহিনিকে নব্য ধ্রুপদী আদলে গড়ে তুলেছেন।
‘বীরাঙ্গনা’
কাব্যের আগেই মাইকেল লিখেছিলেন ‘ব্রজাঙ্গনা’, যেখানে কৃষ্ণপ্রেমে মত্ত ব্রজগোপীদের আত্মকথন ছিল প্রধান
বিষয়।
তাঁর
সমগ্র সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য বাংলা সাহিত্যে নারীর দুঃখ,
অভিমান ও সংগ্রামের প্রথম শক্তিশালী কাব্যিক প্রকাশ। মাইকেল মধুসূদন দত্তের
সাহিত্যিক প্রতিভার অনন্য নিদর্শন এটি। তবে, কাব্যগুণ ও প্রভাব বিবেচনায় ‘মেঘনাদবধ
কাব্য’ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য এবং সম্ভবত মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ
সৃষ্টি। তবে,
‘বীরাঙ্গনা’ নারীর বেদনার কণ্ঠস্বরের এক কালজয়ী সাহিত্য নিদর্শন, যা বাংলা সাহিত্যকে
সমৃদ্ধ করেছে এবং যুগে যুগে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে চলবে।
২
উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার ফলে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে
বাঙালির পরিচয় ঘটে। এরই ফলে বাঙালি জীবনে অকস্মাৎ এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং এর
ফলও সুদূরপ্রসারী। এ বোধই পরিচিতি পায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ হিসেবে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত উনিশ শতকের মানসপুত্র। নবজাগরণের ফলে তার হৃদয়ে স্ফূর্তি ঘটে,
মানস লোক আশ্চর্য এক সৃষ্টি প্রতিভায় সচকিত হয়ে ওঠে। তিনি নিজের মধ্যে অপার আনন্দ,
এক পরম শান্তি অনুভব করেন। মানব জীবন তার কাছে অপার রহস্যময় হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বজগৎ
সমস্ত সৌন্দর্য ও মাধুর্য নিয়ে উপস্থিথ হয় তার চেতনালোকে।
এই সৌন্দর্য ও মাধুর্য তাঁকে তাড়িত করে নতুন সৃষ্টির তাগিদে। ব্যক্তিগত জীবন
থেকে শুরু করে সাহিত্য জীবন পর্যন্ত তাঁর মধ্যে নতুনত্ব আনয়নের চেষ্টা লক্ষ করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে নতুন ভাব ও নতুন আঙ্গিক সৃষ্টির জন্য মধুসূদনের নাম করতে হয়। তাঁর প্রতিটি
সাহিত্য কীর্তিই এই নতুনত্ব প্রকাশের গৌরবে গৌরবান্বিত। এদিক দিয়ে বীরাঙ্গনা কাব্যেও
এর ব্যতিক্রম নেই। পাশ্চাত্য থেকে আঙ্গিক ও ভাবের ইঙ্গিত বহন করে প্রাচ্যের অনুভূতিতে
তাকে শক্তীকরণ করে তিনি আশ্চর্য সুন্দর কাব্য রচনা করেছেন।
মধুসূদন জন্ম বিদ্রোহী আজন্ম যোদ্ধা। ‘বীরাঙ্গনা’ও তার বিদ্রোহী অন্তরের নব অনুভূতির
ফসল। ইউরোপীয় ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ তখন মানবতার পথ ধরে ভারতের সমাজে ও সাহিত্যে
পথ করে নেবার অদম্য চেষ্টায় রত। এই মানবতাবোধের উদার আদর্শ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের
তীব্র অনুভূতি হৃদয়ে ধারণ করেই সে যুগের সমাজ সংস্কারকগণ এগিয়ে এসেছিলেন বাংলার নারীমুক্তির
প্রচেষ্টায়। সতীদাহ প্রথা নিবারিত হল, হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ আইন পাস হল, বহু বিবাহ
ও কৌলিন্য প্রথা নিরোধের জন্য প-িত ঈশ্বরচন্দ্র ও সুহৃদ বর্গের ক্লান্তির বিরাম ছিল
না। কারণ সমগ্র মধ্যযুগ ধরে বাংলাদেশের সমাজ জীবনে নারীর যে অবস্থা ছিল তাকে মানবীয়
বলে উল্লেখ করা চলে না। মানবীকে দেবীর আসনে বসালে তাকে যে আসলে সম্মান দেয়া
হয় না বরং অসম্মানই করা হয় তা উনিশ শতকের মনীষীগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই সেদিন
নারীকে একান্তভাবেই নারী করে না রেখে তাদের মানুষ করে উঠতে চেষ্টা নিয়ে ছিলেন।
ধর্ম ও নীতির শত সহ¯্র বন্ধন ও আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীকে উনিশ শতকের নজজাগ্রতি মুক্তি
দিতে চেষ্টা নিয়েছিল। সমাজের এইসব পরিকল্পিত পরিবর্তন মধুসূদনকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি
বুঝে ছিলেন যে, বাংলার নারীর মনে আত্মভাবনা ও অহংচেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে- নইলে দেশের
অগ্রগতি সম্ভব নয়। সে কারণে দৃঢ়চিত্তে লেখনী ধারণ করেন তিনি, তাঁকে সহায়তা করেন একদিকে
পাশ্চাত্যের কবিকুল অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় শৌর্য বীর্যে পৌরুষ সম্পন্ন নারী চরিত্র।
বীরাঙ্গনা কাব্যের আঙ্গিক ও নামকরণের দিক থেকে মধুসূদন পাশ্চাত্য কবিদের কাছে ঋণী।
ইতালীর কবি ওভিদের হিরোয়দস কাব্যের পত্ররীতি অবলম্বন করে বীরঙ্গনা কাব্য রচিত। বিভিন্ন
কারণে পরিত্যক্ত নারীর মনোবেদনা পত্রগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। মধুসূদনের নায়িকারা
দৈহিক বীরত্ব ও মৌখিক আস্ফালনের জন্য বীরঙ্গনা আখ্যা পাননি, তাদের বীরত্ব চিরাচরিত
সামাজিক রীতিনীতির শৃঙ্খল ও জড়তার আচরণ ঘুরিয়ে দিয়ে হৃদয়ের সত্য প্রকাশে। বনবাসিনী
শকুনতলার পক্ষে হৃদয়ের অনুভূতি কথা প্রকাশ্যে দুষ্মন্তকে বলা অথবা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ
আনয়ন করা এ চিরাচরিত ভারতীয় নীতিবিরুদ্ধ। এরা পতির কাজের সমালোচনা শোনা পর্যন্ত পাপ
মনে করে। সে সময়ে বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের এমন অবস্থা ছিল যে তারা পতিনিন্দা
করা তো দূরে থাক কেউ যদি পতির নিন্দা করতো তাহলে তারা সে স্থান ত্যাগ করতো। এদের
আদর্শ ছিল সতী, যিনি পতির নিন্দা শুনে প্রজ্বলিত যজ্ঞকু-ে আত্ম নিসর্জন দিয়েছেন। মধুসূদনের
বীরাঙ্গনা সে যুগের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়ে স্বীয় পতির দোষগুণের সমালোচনাই শুধু করেনি,
পতীর প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছে। প্রবল অহমিকায় বিশ্বাসী এবং নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য
রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রমণী মূর্তিকে মধুসূদন তাঁর কাব্যে অংকন করেছেন।
বীরাঙ্গনা কাব্যে বিভিন্ন ধরনের পত্র সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রেমবিষয়ক পত্র,
প্রেম প্রত্যাখ্যানজনিত পত্র এবং স্বামীর অত্যাচারে কিংবা দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ রমণী
হৃদয়ের ক্ষোভের পত্র।
প্রচলিত ছিল যে, ভারতীয় নারী স্বামীর নিকট বিক্রীত। নারী তার দেহে, মনে স্বামীর কাছে
আত্মনিবেদিত। তার নিজের কোন বৈশিষ্ট্য নেই। সংসারের নিয়ম-নীতিতে সে অষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।
কিন্তু মধুসূদনের কাব্য রচনা যেহেতু নবজাগরণের পরে সেহেতু তাতে ইউরোপীয় ব্যক্তি মানসের
ছায়া পড়েছে।
যেমন ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ এই পত্রে দশরথের অন্যায় কার্যে স্ত্রী কেকয়ী তাকে নানান
ভাষায় নানানভাবে শ্লেষপূর্ণ বাক্যে রাজাকে অবজ্ঞা করছে। সে এ কথাও বলে বেড়াচ্ছে যে-
সে এ পুরী ছেড়ে চলে যাবে এবং দেশে দেশে বলে বেড়াবে ‘পরম অধর্মচারী রঘুকুল পতি!’ পুত্রের
সিংহাসন আরোহণ করানোর জন্য স্বামীর অন্যায়কে সে সহ্য করেনিÑ কারণ দশরথ অঙ্গীকার করেছে
কেকয়ী পুত্র ভরতকে সিংহাসনে বসাবে। অঙ্গীকার ভেঙে রামকে কেন সিংহাসনে বসাচ্ছে। কেকয়ীর
কাছে এটি অঙ্গীকার ভঙ্গের অপরাধ। অন্যান্য পত্রের মত এ পত্রখানিও ভাষার তীব্রতায় শ্রেষ্ঠ।
‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে ও স্বামীর মীমাংসাকে মেনে নিতে পারেনি জনা। অশ্ব মেধ যঙ্গের
অশ্ব ধরেছিল জনার পুত্র প্রবীর। পার্থের সঙ্গে যুদ্ধে সে নিহত হয়। কিন্তু পিতা নীলধ্বজ
শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা করেÑ এটা জনা সহ্য করতে পারেনি। স্বামীকে পুত্র হন্তার সঙ্গে
মিত্রতা করার জন্য যে অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় লিখেছেÑ তারই নিদর্শন এ পত্র।
এভাবে স্বামীর অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ স্ত্রীর হৃদয়াবেগ প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন পত্রে।
ব্রজাঙ্গনার মতো বীরাঙ্গনাও লিরিক কাব্য। ভাষার লালিত্যে এ ছন্দের পারিপাট্টে বীরাঙ্গনা
মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ রচনা।
‘তিলোত্তমা’ ও ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন তা ‘বীরঙ্গনা
কাব্যে পূর্ণতা পেয়েছে। ‘বীরঙ্গনা’ কাব্যের ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য পাঠককে মুগ্ধ করে। এর
সর্বত্রই একটা সংগীত ধ্বনি ঝংকৃত হয়ে কাব্যখানিকে পরম উপাদেয় করে তুলেছে। কবিত্ব শক্তির
দিক দিয়ে বিচার করলে মেঘনাদ বধ উৎকৃষ্ট কিন্তু ভাষার লালিত্যে ও ছন্দের পারিপাট্টে
বীরঙ্গনা সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা। কারণ মেঘনাদ বধ বাক্যে দুরূহ শব্দ সুপাঠের জন্য বিঘœ সৃষ্টি
করে। কিন্তু বীরাঙ্গনায় তা নেই। এখানে সুচিত শব্দের সুবিন্যাস ঘটেছে। তা ছাড়া ‘বীরাঙ্গনা’
কাব্যে করুণ রস সৃষ্টিতে অসাধারণ শিল্প কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন মধুসূদন। এ কথা বলা অযৌক্তিক
হবে না যে সমাজে কোন না কোন কারণে নিন্দিতা নারীর হৃদয় উদ্ঘাটন করে মাইকেল নারী ও নারীত্বকে
বীরঙ্গনা কাব্যে ইউরোপীয় আদলে মহিমান্বিত করেছেন। (এই অংশটি দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা থেকে সংগৃহীত)
৩
মাইকেল
মধুসূদন দত্ত আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার বা স্রষ্টা। তিনি তার ইউরোপীয়
সাহিত্যের বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞানে, দুঃসাহসিক কবি প্রতিভার প্রবল শক্তিমত্তা ও
আত্মবিশ্বাসে বাংলা কবিতাকে একটি সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত করে আধুনিক জীবনচেতনার
বৃহত্তর জগতে ব্যপ্তির ঐশ্বর্য দিয়েছেন। এ জীবনবোধ ও প্রতিভার দুর্জয় শক্তিতেই
নতুন জীবনদর্শনের উপযুক্ত আধার নির্মাণের তাড়নায় মধুসূদন প্রচণ্ড দুঃসাহসে বাংলা
কাব্যে দীর্ঘকাল প্রচলিত পয়ারে চরণান্তিক মিল এবং শ্বাসাতি ও অর্থতির যান্ত্রিক
ঐক্যবন্ধনকে ভেঙে মিল্টনের ব্ল্যাঙ্ক ভার্সের অনুসরণে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ' সৃষ্টি
করেছেন। মানুষের হৃদয়ের সর্বপ্রকার অনুভূতির প্রকাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দের শক্তি
সংশয়াতীতরূপে প্রমাণিত। হোমারের ইলিয়াড, ভার্জিলের ইনিদ, দান্তে ও মিল্টনের
মহাকাব্য, বাল্মীকির রামায়ণ ইত্যাদি রচনা থেকে ভাব, বিষয়বস্তু ও প্রকাশ কলা আহরণ
করে মধুসূদনই বাংলা ভাষায় সার্থক মহাকাব্য রচনায় সফল হয়েছিলেন। আর এভাবেই
মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিক কাব্যে জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রাখেন ।
বাংলা
সাহিত্যের একমাত্র পত্রকাব্যের নিদর্শন হলো বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২)। এ কাব্যটি
ইতালির কবি ওভিদের Heroides কাব্যের আদর্শানুসারে লিখিত পত্রকাব্য । যিশু
খ্রিস্টের জন্মের অব্যবহিত পরে রচিত ওভিদের কবিতাগুলোর মূল বিষয়বস্তু প্রেম হলেও
উপকরণ ছিল পুরাণের। মধুসূদনও তাই। তিনি অভিমান ও অনুযোগের যোগসূত্র দিয়ে বিভিন্ন
ধরনের এবং বিভিন্ন অবস্থানের কয়েকজন ক্ষুব্ধা ও বিরহিনী নারীকে সফলভাবে এ কাব্যে
অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ওভিদের কাব্যের পত্রসংখ্যা ছিল একুশ। মধুসূদন এগারোটি পত্র
সম্পূর্ণ করেছিলেন। আরো কয়েকটি শুরু করলেও তার পক্ষে শেষ করা সম্ভব হয় নি।
ওভিদের কাব্যের নায়িকারা তাদের স্বামীর উদ্দেশ্যে প্রধানত প্রেম উদ্বোধিত চিত্তে
পত্র রচনা করেছে। তিনি এদেশের পৌরাণিক নারী চরিত্র উপজীব্য করে পত্র রচনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে পত্রাকার কাব্যরচনা প্রথম দেখা
যায় বীরাঙ্গনা কাব্যে। ১৮৬২ সালে এই গ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয় । দুষ্মন্তের
প্রতি শকুন্তলা, সোমের প্রতি তারা, দ্বারকনাথের প্রতি রুক্মিণী, দশরথের প্রতি
কৈকয়ী, লক্ষণের প্রতি সুপর্ণখা, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি
ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, পুরুবার প্রতি উর্বশী,
নীলধ্বজের প্রতি জনা- এই ১১টি পত্ররূপী কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি রচিত। মধুসূদন
তাঁর কাব্যে এই নারীদের পুরাণ- পরিচিতির মূলে আঘাত করেছেন। তিনি মানবিক অনুভূতির
আলোকে নারী হৃদয়ের কথকতায় ব্যক্ত করিয়েছেন।
মধুসূদনের নায়িকারা দৈহিক বীরত্ব ও মৌলিক
আস্ফালনের জন্য বীরাঙ্গনা আখ্যান পান নি, তাঁদের বীরত্ব চিরাচরিত সামাজিক
রীতিনীতির শৃঙ্খল এবং জড়তার আবরণ ঘুচিয়ে হৃদয়ের সত্য প্রকাশে উদ্গ্রীব।
বনবাসিনী শকুন্তলার পক্ষে হৃদয়ের অনুভূতির কথা প্রকাশে দুষ্মন্তরে বলা অথবা তাঁর
বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, এ চিরাচরিত ভারতীয় নীতিবিরুদ্ধ, এঁরা পতির কার্যের সমালোচনা
শোনা পর্যন্ত পাপ মনে করেন। মধুসূদনের সমকালীন বাংলার সমাজের মেয়েদের রীতি ছিল
নিজেরা পতি নিন্দা করলে অনন্ত নরকে বাস করবেন। এঁদের পৌরাণিক আদর্শ ছিলেন সতী,
যিনি পতি নিন্দা শুনে প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞকুন্ডে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন।
মধুসূদনের বীরাঙ্গনারা সে যুগের এ আদর্শ থেকে
চ্যুত হয়ে স্বীয় পতির দোষগুণের আলোচনাই শুধু করেন নি, পত্নীর প্রতি
দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন। এঁরাই সেকালের সমাজদ্রোহী বিদ্রোহী কবি আত্মার অমর
শিল্পসৃষ্টি। বীরাঙ্গনার ভিন্নধর্মী নারী চরিত্রগুলো সকলেই কবিচিত্ত বন থেকে
সমভাবে মধু আহরণ করে সার্থকতা প্রাণধর্মে উজ্জীবিত হয়েছে। কবির সহানুভূতি
আশ্রমকন্যা শকুন্তলার প্রতি যতটুকু, স্বর্গ অপ্সরার প্রতি তার চেয়ে কম নয়,
বিদ্রোহী জনার জন্য তাঁর যতটুকু সহানুভূতি, কলঙ্কিনী, তারাও তাঁর ততটুকু হৃদয়
অনুভূতিই আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বীরাঙ্গনায় বনবাসিনী থেকে শুরু করে স্বর্গের
উর্বশী এবং ব্যভিচারিণী তারা সবাই হৃদয় অনুভূতির অসঙ্কোচ প্ৰকাশে গরবিনি। নারী
চরিত্র রূপায়ণে এ অনুভূতি আমরা পেয়েছি আমাদের আজকের দিনের ঔপন্যাসিকের কাছে।
কবির কাছ থেকে তো দূরের কথা বঙ্কিমের উপন্যাসেও এ রীতি ছিল অন্যায়, ভয়াবহ ও
সমাজদ্রোহ। কিন্তু বিদ্রোহী কবি মধুসূদন চিত্তের অসঙ্কোচ প্রকাশে ছিলেন সমৃদ্ধ।
তাই বাস্তব অনুভূতির অসঙ্কোচ প্রকাশে প্রতিটি নারী চরিত্র সচেতনতায়, স্বকীয়
বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং কবির সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ শক্তি ও মননশীল মনের
সাথে আমাদের পরিচয় করে দেয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, পত্রগুলোর কোন নারী
নিষিদ্ধ প্রেমে উন্মাদিনী, কেউ প্রিয় সঙ্গ লাভের জন্য কামাতুরা, কেউবা দুর্বল
ভীরু। স্বামীর প্রতি তীব্র বাক্যবাণ বর্ষণে অকৃপণা। বীরাঙ্গনা কাব্যের
চরিত্রগুলোতে কামনার রক্তরাগ এবং চরিত্রের সুদৃঢ় স্বাতন্ত্র্য প্রাধান্য পেয়েছে।
তাই বলা যায়, বীরাঙ্গনা পত্রকাব্যটি সব দিক মিলিয়ে সফলতার দাবিদার।