ভূমিকা : বিশিষ্ট আধুনিক কবি আল মাহমুদ তার কাব্য কবিতায়
লোকায়ত জীবন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। তার
‘সোনালী কাবিন' সনেট গুচ্ছের অন্তর্গত ‘সোনালী কাবিন : ৫’ একটি প্রেমমূলক কবিতা। কবি
এ কবিতায় চৌদ্দ পঙক্তির সীমিত পরিসরে স্বকীয় প্রেম ভাবনার স্বাতন্ত্র্য উপস্থাপন
করেছেন। এ কবিতায় ইতিহাস ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে ও নিসর্গের পটভূমিকায় নরনারীর প্রেম
চিরন্তন বাস্তবতাকে ধারণ করেছে ।
শরীরী প্রেম : কবি আল মাহমুদ ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় নরনারীর
শরীরী প্রেমের চিরন্তন আকুতিকে তুলে ধরেছেন। অশরীরী নিষ্কাম প্রেমে তার আসক্তি নেই।
প্রেমের ভাবনায় তিনি বাস্তবতার অনুসারী। দেহজ প্রেমের বাস্তব ও চিরন্তন মাহিমাকে মাটির
বোতল নিয়ে কাছে আসার আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি প্রেমিকাকে পেতে চেয়েছেন আদিম কামনার
উচ্ছ্বাসে উন্মত্ত হয়ে । যুগ যুগান্তর ধরে মানব মানবীর দেহজ প্রেমের যে ধারা বহমান,
কবির প্রেম ভাবনা সে ধারায় বিকশিত। তিনি নরনারীর দেহকেন্দ্রিক প্রেমকেই বাস্তব সত্য
মনে করেন । কারণ নরনারীর পরস্পরের দৈহিক সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ ও শারীরিক প্রেমাকাঙ্ক্ষাই
চিরন্তন ও সহজাত।
ঐতিহ্যগত প্রেম : ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় কবি প্রেমের ক্ষেত্রে
ঐতিহ্যের অনুসারী হয়েছেন । তার দেহকেন্দ্রিক প্রেম ভাবনার মূলে রয়েছে ঐতিহ্য চেতনা।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে নরনারীর দেহজ প্রেমাকাঙ্ক্ষার যে ইঙ্গিত রয়েছে,
কবি আল মাহমুদ সেই শরীরী প্রেমকেই আরও উপভোগ্য করে ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় উপস্থাপন
করেছেন। গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী' এ পঙ্ক্তিতে কবির ঐতিহ্যগত প্রেমচেতনা
স্পষ্ট। চর্যাপদে বর্ণিত শবর শবরীর দেহজ প্রেমের উষ্ণতা কবির মনে মিলনের আকাঙ্ক্ষা
জাগিয়েছে । তাই শবরীর প্রতি তার আহ্বান-
“কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল নিয়ে এসো চন্দ্রলোকে তৃপ্ত
হয়ে আচমন করি ৷ ”
এ পঙক্তি থেকে বুঝা যায়, কবি চর্যাপদের ঐতিহ্য সূত্রে মহুয়া ফুল
থেকে উৎপন্ন মদ পান করে প্রিয়তমার সাথে দেহজ কামনায় উন্মত্ত হতে চেয়েছেন ৷
প্রকৃতির অনুষঙ্গে প্রেম : 'সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় কবির প্রেম
ভাবনার সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্য একাকার হয়েছে। কবি তার প্রিয়তমার যৌবনের পূর্ণতাকে
ফেটে যাওয়া কার্পাস উপকরণে সজ্জিত প্রিয়াকে দেখে তিনি চোখের নেশা মিটাতে চান। তাই
প্রেমিকা শবরী বালাকে তিনি গলায় গুঞ্জার মালা পরার পরামর্শ দিয়েছেন। দেহজ প্রেমে
আসক্ত কবি নিসর্গের আশ্রয়ে প্রেমের পূর্ণতা উপলব্ধি করেন । তার ভাষায়-
“নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল ।”
কবির ধারণা, বৃক্ষ যেমন মাটির গভীরে শিকড় গ্রথিত করে আত্মবিকাশের
পথ খুঁজে পায়, তেমনি নরনারীর প্রেমও শরীরকে কেন্দ্র করে পূর্ণতা লাভ করে। কবি নিসর্গের
মধ্যেই শরীরী প্রেমের বাস্তবরূপ প্রত্যক্ষ করেন ; তার দেহজ প্রেমের আকাঙ্ক্ষা নিসর্গের
আবরণে সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। নিসর্গের সৌন্দর্যই কবির শরীরী প্রেম ভাবনাকে অধিকতর
শিল্পিত করেছেন ।
লোকজ চেতনায় প্রেম : কবি আল মাহমুদ তার স্বকীয় প্রেম ভাবনায়
লোকায়ত চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি তার প্রেমিকাকে লোকজ অভিধায় প্রাণের
শবরী বলে সম্বোধন করেছেন। তার নায়িকা আধুনিক কোনো ললনা নয়; বরং যৌবনবতী এক শবরী বালিকা।
লোকজ জীবন চেতনায় তিনি তাকে গুঞ্জার মালায় সাজাতে চেয়েছেন। নিজেকে শবর যুবকরূপে
কল্পনা করে কবি তার প্রিয়তমাকে শবরী বালারূপে দেখেছেন। চর্যাপদের শবর যুবকের মতো উন্মাতাল
হয়ে তিনি তার প্রাণের শবরীকে নিয়ে দেহজ প্রেমলীলায় বিভোর হতে চেয়েছেন। কবি এমন
এক শবরীকে কামনা করেছেন যে ‘মহুয়ার মাটির বোতল' নিয়ে চন্দ্রালোকে এসে তার সাথে প্রেমলীলায়
উন্মত্ত হবে। ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় লোকায়ত জীবনের বাস্তবতায় নরনারীর প্রেম
অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ।
শাশ্বত প্রেম : মানুষের জীবন ও সভ্যতা ক্ষণস্থায়ী হলেও নরনারীর
প্রেমের আকাঙ্ক্ষা চিরন্তন। ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় কবি ক্ষণস্থায়ী জীবনের মধ্যে
প্রেমের চিরস্থায়ী রূপের সন্ধান করেছেন। কবি জানেন এ জগতে সবকিছুই পরিবর্তশীল। কালের
প্রবাহে সবকিছু অস্তিত্ববিলীন হয়ে যায়। মহাকাল তার সর্বগ্রাসী স্রোতে বর্তমানকে ভাসিয়ে
নিয়ে যায় অতীতের বিবর্ণ অন্ধকারে। মানুষের জীবন ও সভ্যতাও চিরস্থায়ী নয়। সময়ের
ব্যবধানে পৃথিবীর বুকে সভ্যতার পরিবর্তন ঘটে। পুরাতন সভ্যতা ধ্বংস হয়ে আবার নতুন সভ্যতার
ভিত রচিত হয়। কিন্তু তাও আবার চিরকাল টিকে থাকে না। মহাকালের তীব্র স্রোতে এরও অনিবার্য
বিনাশ ঘটে। কিন্তু মানব মানবীর দেহজ কামনাবাসনার কোনো পরিবর্তন নেই। আদিমকাল থেকে নরনারীর
মনে যে দেহজ কামনার ধারা বহমান, কালের স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অনন্তের পথে
। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মন্তরে দেহজ প্রেমের ধারা অবিরাম চলছে তো চলছেই । কালের স্রোত
মানব মানবীর দেহজ প্রেমের আকাঙ্ক্ষাকে বিনাশ করতে পারেনি। ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায়
কবি এ দেহজ প্রেমের বন্ধনকে চিরস্থায়ী ও চিরন্তন মনে করেছেন ।
আত্মিক পরিশুদ্ধতার জন্য প্রেম : ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় কবি
দেহজ প্রেমের মধ্য দিয়ে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পথ খুঁজেছেন। চর্যাপদের কবিদের মতো
তিনিও হয়তো বিশ্বাস করেন যে, দেহজ প্রেমবন্ধনের মধ্য দিয়ে হৃদয়ের দ্বার উন্মোচন
করা, আত্মার মলিনতা দূর করা সহজ। তাই তিনি নরনারীর দেহজ মিলনের মধ্য দিয়ে দেহকে পবিত্র
করে আত্ম বিকাশের পথ নির্মাণ করতে চেয়েছেন । তাই কবির দেহজ প্রেমের ভাবনাকে নিতান্ত
স্থূল দৈহিক কামনা থেকে উৎসারিত বলা যায় না। কবি মূলত দেহজ প্রেমের মাধুর্যের মধ্যে
নির্মল আত্মার সন্ধান করেছেন ।
উপসংহার : ‘সোনালী কাবিন : ৫' কবিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনার
আলোকে নরনারীর প্রেমের সৌন্দর্য ও সার্থকতা তুলে ধরেছেন। তিনি বাঙালির লোকায়ত জীবন
ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রভৃতির মিশ্রণে ও নিসর্গের পটভূমিকায় নরনারীর প্রেমকে আকর্ষণীয়
অভিব্যঞ্জনীয় মহিমান্বিত করেছেন ।
২
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি আল মাহমুদ তার কাব্যে লোকায়ত জীবন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্যেরপরিচয় তুলে ধরেছেন। তার সনেটগুচ্ছ ‘সোনালী কাবিন’ বাংলা কবিতার এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানেতিনি প্রেম, প্রকৃতি এবং ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে জীবন ও জগতের গভীর ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।এই সনেটগুচ্ছের অন্তর্গত ‘সোনালী কাবিন : ৫’ একটি প্রেমমূলক কবিতা, যা চৌদ্দ পঙক্তিরসীমিত পরিসরে কবির স্বতন্ত্র প্রেম ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে।
‘সোনালী কাবিন : ৫’ কবিতায় আল মাহমুদ নরনারীর প্রেমের
শারীরিক বাস্তবতাকে চিরন্তন সত্য হিসেবে তুলে ধরেছেন। অশরীরী, নিষ্কাম প্রেমে তার কোনো
আকর্ষণ নেই; বরং তিনি প্রেমের দৈহিক দিককেই জীবনের মূল বাস্তবতা মনে করেন। কবিতায়
কবি তার প্রেমিকাকে মাটির বোতল নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে দেহজ কামনার উচ্ছ্বাসে মিলিত
হতে চান। কবির দৃষ্টিতে প্রেম কোনো কল্পনাজাত আদর্শিক চিন্তা নয়; এটি মানব জীবনের
সহজাত প্রবৃত্তি। যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতার পরিবর্তন ঘটলেও দেহজ প্রেমের আকাঙ্ক্ষা
চিরস্থায়ী। কবিতায় তিনি লেখেন:
“কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো
চন্দ্রলোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।”
এখানে কবি শবরীর প্রতি তার আদিম কামনারউচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। চর্যাপদের মতোই তিনি নরনারীর দেহজ আকর্ষণের ঐতিহ্য চেতনা ধারণকরেছেন।
‘সোনালী কাবিন : ৫’ কবিতায় কবি ঐতিহ্য চেতনা দ্বারা
গভীরভাবে প্রভাবিত। তার প্রেমিকা কোনো আধুনিক শহুরে নারী নয়; বরং তিনি তাকে শবরীরূপে
কল্পনা করেছেন। কবি শবরীর গলায় গুঞ্জার মালা পরার পরামর্শ দিয়ে তাকে লোকজ রূপে সাজিয়েছেন।
এটি বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতি কবির মমত্ববোধ প্রকাশ করে।
“গলায় গুঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণেরশবরী।”
এখানে কবি শবর শবরীর দেহজ প্রেমের ঐতিহাসিকউষ্ণতাকে তুলে ধরেছেন এবং তা থেকে চিরন্তন প্রেমের সৌন্দর্য উপলব্ধি করেছেন।
কবিতায় কবি নিসর্গের সৌন্দর্যের সঙ্গে
প্রেমের মাধুর্য একাকার করে দেখেছেন। তার ভাষায়:
“নিসর্গের গ্রন্থ থেকে, আশৈশব শিখেছি
এ-পড়া
প্রেমকেও ভেদ করে সর্বভেদী সবুজের মূল।”
এটি থেকে বোঝা যায়, কবির দেহজ প্রেম
নিসর্গ থেকে শক্তি পেয়েছে। গাছের মাটির গভীর শিকড় যেমন তার বিকাশের উৎস, তেমনি প্রেমও
শরীরকে কেন্দ্র করেই পূর্ণতা লাভ করে।
কবির দৃষ্টিতে দেহজ প্রেম শুধুমাত্র দৈহিকআকর্ষণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আত্মার মলিনতাকে দূর করে এক পবিত্রতার পথ প্রশস্ত করে।তিনি চর্যাপদের মতোই বিশ্বাস করেন, দেহজ প্রেমের মাধ্যমে আত্মার গভীরতা উপলব্ধি করাসম্ভব। এটি তার প্রেম ভাবনাকে আরও উচ্চতর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ প্রদান করেছে।
‘সোনালী কাবিন : ৫’ কবিতায় কবি তার নিজস্ব প্রেম
ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। লোকায়ত জীবন, ঐতিহ্য ও নিসর্গের সংমিশ্রণে নরনারীর প্রেমকে
গভীর এবং চিরন্তন করে তুলেছেন। কবির দৃষ্টিতে প্রেম মানব জীবনের মৌলিক এবং অবিচ্ছেদ্য
অংশ, যা নিসর্গ ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে আরও মহিমান্বিত হয়েছে। কবিতাটি আল মাহমুদের
কাব্যিক প্রতিভার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।