কাব্যের মধ্যে
পূর্বাপর সংগতি ও ধারাবাহিকতাপূর্ণ কোনো কাহিনি পরিবেশন করলেই তাকে ‘আখ্যায়িকা-
কাব্য'রূপে চিহ্নিত করা হয়। আর আখ্যায়িকা কাব্য যখন কোনো মহৎ জাতীয় জীবনাদর্শের
আধার হয়ে ওঠে, তার বর্ণনায়, চিত্রকল্পে ও চরিত্র চিত্রণে সেই ভাব সমুন্নতি
উদ্ভাসিত হয় তখনই সেই রচনা মহাকাব্যের মর্যাদা অর্জন করে। উনিশ শতকের বাঙালি
কবিরা বায়রন, মুর, স্কট প্রমুখের কাহিনিকাব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। আখ্যায়িকা
কবিতার রোমান্টিক কল্পনা, বৈচিত্র্য, কাহিনিরস ও নাটকীয়তা প্রভৃতি তাঁরা কবিত্বের
গৌরবরূপে অনুভব করেছিলেন। আখ্যায়িকা কাব্য ও মহাকাব্যকে দেশাত্মবোধ প্রকাশের
উপযুক্ত মাধ্যমরূপেও তাঁরা অনুভব করে তাঁদের আদর্শে বাংলা ভাষার আখ্যায়িকা ও
মহাকাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
রঙ্গলাল:
ইংরেজি শিক্ষিত প্রথম বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের
শিষ্য এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েও শেকসপিয়র, স্কট, বায়রন, বিশেষত টমাস মুরের
অনুসরণে পাশ্চাত্য রোমান্টিক কবিকল্পনার প্রয়োগে বাংলা কাব্যে আধুনিক ধারা
ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশাত্মবোধকে কাব্যের বিষয়বস্তুরূপে গ্রহণ করেছেন। টডের ‘রাজস্থান’
কাহিনি থেকে বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে রঙ্গলাল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আখ্যানকাব্য
'পদ্মিনী উপ্যাখ্যান' রচনা করেছিলেন। ইতিহাসলব্ধ বিষয়বস্তু প্রকৃতি বর্ণনা ও
রোমান্টিক দেশপ্রেম গতানুগতিক কবিতার জীর্ণ আধারে নতুন রস সঞ্চারিত করেছে। রাজা
ভীমসিংহের ক্ষত্রিয়দের প্রতি উৎসাহ বাণী 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়' এদেশে দেশাত্মবোধের উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছিল। রঙ্গলালের
দ্বিতীয় আখ্যানকাব্য ‘কর্মদেবী'র চারসর্গ সংবলিত কাহিনিও রাজপুত্র ইতিহাস থেকে
সংগৃহীত। নায়ক সাধুর চরিত্র পরিকল্পনা দেশপ্রেমের আদর্শের ছবি স্পষ্টতরভাবে
অঙ্কিত। তৃতীয় কাব্য ‘শূর-সুন্দরী'র কাহিনিরও ভিত্তি রাজপুত্র ইতিহাস ।
কাব্যটি
সম্পূর্ণরূপেই বর্ণনাত্মক। রঙ্গলালের তৃতীয় আখ্যানকাব্য 'কাঞ্চীকাবেরী'র বিষয়বস্তু
উড়িষ্যার ইতিহাসের একটি রোমান্টিক কাহিনি। এই কাহিনির কাঠামো কবি পেয়েছিলেন
পুরুষোত্তম দাসের ওড়িয়া কাব্যে। কাহিনির আধুনিক রূপ রচনার জন্য তার একটু
ঐতিহাসিক ভূমিকা দিয়েছেন এবং কাঞ্চীর যুদ্ধ রাজপুত যুদ্ধের আদর্শে বর্ণনা করেছেন।
‘কাঞ্চীকাবেরী'র রোমান্টিক বিষয়বস্তুতে ভক্তিরস প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু রঙ্গলাল
কাব্য প্রকরণে প্রাচীন কাব্যধারাই অনুসরণ করেছেন, ভাষা, ছন্দ ও প্রকাশকলায় তিনি
কোনো মৌলিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁর 'কর্মদেবী' প্রকাশের পূর্বেই বাংলা কাব্য
সাহিত্যে মধুসূদন আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার ফলে রঙ্গলালের কবিখ্যাতি ম্লান হয়ে
পড়ে।
মাইকেল
মধুসূদন দত্ত: মাইকেল মধুসূদন দত্তই আধুনিক বাংলা
কাব্যের রূপকার বা স্রষ্টা। তিনি তাঁর ইউরোপীয় সাহিত্যের বিস্তৃত ও গভীর জ্ঞানে,
দুঃসাহসিক কবিপ্রতিভার প্রবল শক্তিমত্তা ও আত্মবিশ্বাসে বাংলা কবিতাকে একটি
সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত করে আধুনিক জীবনচেতনার বৃহত্তর জগতে ব্যাপ্তির ঐশ্বর্য
দিয়েছেন। এই জীবনবোধ ও প্রতিভার দুর্জয় শক্তিতেই নতুন জীবনাদর্শের উপযুক্ত আধার
নির্মাণের তাড়নায় মধুসূদন প্রচণ্ড দুঃসাহসে বাংলা কাব্যে দীর্ঘকাল প্রচলিত
পয়ারে চরণান্তিক মিল এবং শ্বাসযতি ও অর্থযতির যান্ত্রিক ঐক্যবন্ধনকে ভেঙে
মিল্টনের ‘ব্ল্যাঙ্ক ভার্সে'র অনুসরণে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ' সৃষ্টি করেছেন। তাঁর ১৮৬০
সালে প্রকাশিত বর্ণনাময় কাব্য 'তিলোত্তমাসম্ভব'কে মধুসূদন নিজেই Epicling বা
'মহাকব্যিকা' বলেছেন। এই আখ্যায়িকা কাব্যটি মধুসূদনের শিক্ষানবিশ পর্বের রচনা।
ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও রচনাটিতে মধুসূদনের শক্তির পরিচয় ফুটে ওঠে।
১৮৬১ সালে
প্রকাশিত 'মেঘনাদবধ কাব্যে' মধুসূদন তার নতুন জীবনবোধের প্রকাশে রামায়ণ কাহিনির
রূপান্তর ঘটিয়েছেন : দুরাচারীরূপে চিরনিন্দিত রাক্ষসরাজ রাবণকে তাঁর কাব্যের
নায়ক হিসেবে গ্রহণ করে তার মধ্যে সর্ব বন্ধনমুক্ত, আত্মশক্তিতে বলিষ্ঠ,
আত্মমর্যাদা সচেতন আধুনিক মানুষের পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ও জীবনাদর্শকে রূপায়িত
করেছেন। রাম তাঁর কাছে ভীরু, দুর্বল, প্রতি পদে দেবতাদের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল।
বিভীষণের ধর্মবোধহীন স্বার্থপরতা ও স্বদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর কাছে
অমার্জনীয় অপরাধ ।
মানুষের হৃদয়ের
সর্বপ্রকার অনুভূতির প্রকাশে অমিত্রাক্ষর ছন্দের শক্তি সংশয়াতীতরূপে প্রমাণিত।
হোমারের ইলিয়াড, ভার্জিলের ইনিড, দান্তে ও মিল্টনের মহাকাব্য, বাল্মীকির রামায়ণ
ইত্যাদি রচনা থেকে ভাব, বিষয়বস্তু ও প্রকাশকলা আহরণ করে মধুসূদনই বাংলা ভাষায়
সার্থক মহাকাব্য রচনায় সফল হয়েছিলেন।
হেমচন্দ্র:
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বীরবাহু কাব্য'-এর (১৮৬৪) বিষয় কাল্পনিক। কাব্যটিতে
রঙ্গলালের প্রভাব স্পষ্ট। বীরবাহুর কাহিনিবিন্যাসে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও সংহতির
অভাব, তবে কোথাও কোথাও বর্ণনার লালিত্য আছে। কাব্যকাহিনিতে রূপকথার মতো অনেক
অসম্ভব ঘটনা স্থান পেয়েছে। তবে বাংলাদেশের শিক্ষিতদের মধ্যে সদ্য জাগ্রত
দেশাত্মবোধ এই কাব্যে প্রবল ভাবোচ্ছ্বাসে প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন থেকে তার মূল্য
স্বীকার্য। হেমচন্দ্রের প্রধানতম ও সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত রচনা 'বৃত্রসংহার'
মহাকাব্য ।
ইন্দ্রকে পরাজিত
করে বৃত্রের স্বর্গ অধিকার, ইন্দ্র ও শচীর দুঃখদুর্গতি ভোগের পর দধীচির
অস্থিনির্মিত বজ্রে ইন্দ্রের বৃত্রবধ ও স্বর্গোদ্ধার এই মহাকাব্যের বিষয়বস্তু।
কাহিনির কাঠামোটুকুই শুধু পৌরাণিক, বেশিরভাগ অংশই কবির নিজস্ব কল্পনা, কতকটা
ইংরেজি কাব্যের অনুকরণ। বৃত্রসংহার'-এর কথাবস্তুতে ও পটভূমিতে যে মহাকাব্যোচিত
বিশালতা আছে, মেঘনাদবধ কাব্যে তা দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৈশোর বয়সের
সমালোচনায় 'মেঘনাদবধে’ নয়, ‘বৃত্রসংহারে’ই মহাকাব্যের ভাব সমুন্নতি নির্দেশ
করেছিলেন : “স্বর্গ উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ— যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়। কিন্তু
সমগ্র কাহিনিটি শিথিল, হেমচন্দ্র তাকে মহাকাব্যের সংহতি দিতে পারেননি। তাঁর
চরিত্র- চিত্রণও অত্যন্ত দুর্বল।”
ড. সুকুমার সেন
যথার্থই বলেছেন— “বৃত্রসংহারে
অনেকগুলো ভালোমানুষী চরিত্র আছে বটে কিন্তু যথার্থ মহৎ চরিত্র নাই। একমাত্র মহৎ চরিত্র
দধীচি কাব্যে উপেক্ষিতই রহিয়া গিয়াছে। দেবতাচরিত্রগুলোতে ব্যক্তিত্বের পরিচয়
গোচর নয় ৷ বৃত্রের ভূমিকায় বৈদিক ও পৌরাণিক ইন্দ্রশত্রু অসুরের গম্ভীর মহিমা
পরিস্ফুট নয় । .... বৃত্রসংহারের নায়ক শিবের বরপ্রাপ্ত ভক্তমাত্র, বৃত্রের সম্ভল
চন্দ্রশেখরের দয়া। ভাগ্যের উপর অপরিসীম বিশ্বাস । এইখানে হেমচন্দ্রের বৃত্র
মধুসূদনের রাবণের তুলনায় নিষ্প্রভ। ঐন্দ্রিলার ভূমিকায় অসুর-মহিষীর দৃপ্ত তেজ
ফুটে নাই, ফুটিয়াছে রূপকথার সুয়োরাণীর হিংসা ও অভিমান ।”
নবীনচন্দ্র
সেন: তাঁর 'পলাশীর যুদ্ধ' ঐতিহাসিক গাথাকাব্য। ইংরেজদের লেখা
ইতিহাসে সিরাজ চরিত্র কলঙ্কের কালিমালেপনে আচ্ছন্ন। নবীনচন্দ্র তার ওপরে নির্ভর
করে সিরাজকে নায়কত্বের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর কাব্যে মোহনলালই
প্রাধান্য পেয়েছে, তার মধ্য দিয়েই দেশাত্মবোধ অভিব্যক্ত। নবীনচন্দ্র ‘পলাশীর
যুদ্ধে' অনেক স্থানেই বায়রনের Childe Harold এর যুদ্ধ বর্ণনাপদ্ধতি অসনুসরণ
করেছেন, এমনকি কোথাও কোথাও তার আক্ষরিক অনুবাদ পর্যন্ত করেছেন।
‘পলাশীর যুদ্ধে’র
কাব্যমূল্য বিশেষ কিছু নেই, তবে তার দেশপ্রেমের ভাবোচ্ছ্বাস সমকালীন পাঠকদের
প্রভাবিত করেছিল । নবীনচন্দ্রের ‘ক্লিওপেট্টা' একটি দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা মাত্র,
কবি দ্বিচারিণী ক্লিওপেট্টার প্রতি পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন,
রচনাটির বিশেষত্ব মাত্র এইটুকুই। ‘রঙ্গমতী' স্কটের আদর্শে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য,
কাল্পনিক কাহিনির পটভূমি চট্টগ্রামের রাঙামাটি অঞ্চল, শিবাজীর প্রসঙ্গ সন্নিবিষ্ট
করে কবি রচনাটিকে স্বাদেশিকতার গৌরব দিতে চেয়েছেন। এই রচনাটির কাব্যমূল্যও
অকিঞ্চিৎকর।
নবীনচন্দ্র সেনের
বিষয়বস্তুতে মহাকাব্যোচিত বিশালতা লক্ষণীয়। তাঁর কাব্যে কেন্দ্রীয় ঘটনা
যথাক্রমে সুভদ্রাহরণ, অভিমন্যুবধ ও যদুবংশ ধ্বংস, নিষ্কাম ধর্ম ও নিষ্কাম প্রেমের
সূত্রে আর্য-অনার্যের ঐক্যবন্ধন এবং অখণ্ড হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। এই
উদ্দেশ্য সাধনেই নায়ক শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। তাঁর সহায় ছিল অর্জুনের বীরত্ব,
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মনীষা, সুভদ্রার প্রীতি ও শৈলজার প্রেম। দুর্বাসার
অকারণ প্রতিহিংসা ও অভিমান এবং বাসুকির সংশয় ছিল তাঁর বিরোধী শক্তি। কল্পনা ও
আবেগের মাত্রাহীন অসংযম, রচনারীতিতে শৈথিল্য, সুলোচনার অসংযত কৌতুকচাপল্য ও লঘুতা,
চরিত্র চিত্রণে দুর্বলতা প্রভৃতি মহাকাব্যের গৌরব অর্জনে গুরুতর বাধা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। নিছক আখ্যায়িকা কাব্য হিসেবেও ঘটনা ও চরিত্রের টানাপোড়েন তাদের সংহত
রূপ দিতে কবি ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলা কাব্যধারায়
মহাকবি কায়কোবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর মহাকাব্য মহাশ্মশান বহুল প্রশংসিত।
কায়কোবাদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো অত্যন্ত প্রখর প্রতিভাধর না হলেও তাঁর
বিশেষত্ব আজো অম্লান ।