বাংলা কথা
সাহিত্যে জীবনের রূপায়ণে কথা সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার মূলে রয়েছে
মানবসমাজে ক্রমবর্ধমান জীবন জটিলতার উৎক্ষেপণ। বর্তমানে মানুষের জীবনের অসংখ্য
সমস্যা, যন্ত্রণার মূলে রয়েছে যান্ত্রিক সভ্যতা যা মানুষকে শহরমুখী করে তুলেছে।
কিন্তু সেখানেও সুখ নেই। আছে দারিদ্র্য জীবনযাত্রার প্রতিযোগিতা ও সমাজে ভ্রষ্টাচার
। এ থেকে মুক্তি পায়নি গ্রামীণ জীবন। সেখানেও উক্ত সমস্যা বিরাজমান। সাতচল্লিশ এর
দেশ ভাগের পর অনেকের ছোটগল্পে ফুটে উঠেছে পল্লিজীবনের সুখ দুঃখ বিরাজিত বাস্তবতা।
নিম্নে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুদ্দীন
আবুল কালাম ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের গ্রামীণ জীবন বাস্তবতা তুলে ধরা
হলো:
ক.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের
বিষয়বস্তুর আহরণ ঘটেছে বাংলার গ্রাম সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনবৃত্তে লালিত
ক্ষুদ্র সংঘাত, অপরাধ, লোভলালসা, ভণ্ডামিভরা বিচিত্র বৃত্তীয় চাহিদার তীক্ষ্ণ
অনুভব থেকে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'নয়নচারা’য় বাংলাদেশের আঞ্চলিক জীবনের পরিচয়
আছে। নয়নচারা, মৃত্যুযাত্রা, পরাজয়, খুনী প্রভৃতি গল্প গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত ।
নয়নচারা:
নয়নচারা একটি গ্রাম, যার পাশ দিয়ে রয়েছে ময়ুরাক্ষী নদী। এ গ্রাম থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত
অনেক লোক দুমুঠো ভাতের আশায় শহরে উপস্থিত হয়। আমু সেই ছিন্নমূল মানুষের একজন।
দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারে দারিদ্র্যে জর্জরিত মানুষদের হতাশা এবং সেই হতাশা কিভাবে
মানুষকে পঙ্গু করে দিচ্ছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। দুঃসহ দারিদ্র্য ও
ক্ষুধার পীড়নের নির্মম পাঁচালী এ গল্পটি।
মৃত্যুযাত্রা:
এ গল্পেও লেখক একটি বিশেষ অঞ্চলের দুর্ভিক্ষপীড়িত নিরুপায় মানুষের প্রতিকারহীন
যন্ত্রণাকে রূপ দিতে চেয়েছেন। এ গল্পে দুর্ভিক্ষের শিকার রোগজর্জর মানুষগুলো অবলীলায়
নিজেদের চিহ্নিত করেছে বিষের জগতে। যেখানে আকাল নিত্যসঙ্গী এবং নিশ্চিত মৃত্যুর
অপেক্ষায় করিম তিমু, হাজুর বাপ-মা সবাই দিন গুজরান করে।
পরাজয়:
চরে সর্প দংশনে মৃত ছমিরের বিধবা বৌ কুলসুমের যৌবনদীপ্ত দেহ কালু ও মজনুকে বাসনা ও
কামনা জাগায় দেহটি সম্ভোগ করার। বাইরে ঝড় বৃষ্টি ও উন্মত্ত নদী। নির্জন পরিবেশ
মানুষের মনে যে পশুবৃত্তি জাগ্রত করে তার পরিচয় এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া বাংলা
প্রকৃতির চিরদামাল রূপও এখানে চিহ্নিত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কালু ও মজনু পরাজিত
হয়।
খুনী:
এ গল্পে দেখা যায় রাজ্জাকের ধমনীতে প্রবাহিত চর অঞ্চলের মানুষের রক্ত। যার কারণে
মুহূর্তের ঝোকে খুন করে ফেলে সে। ফলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার দুর্বার তৃষ্ণা
সত্ত্বেও তা আর রাজ্জাকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
খ.
শামসুদ্দীন আবুল কালাম: শামসুদ্দীন আবুল কালামের ৩টি
গল্পগ্রন্থের গল্পসমূহেও গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য, লোভ-লালসা, স্বপ্নভঙ্গের
চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক দিনের আশা গল্পগ্রন্থের ‘পোষস্বপ্ন' ও 'ক্ষুধা' গল্পে
দুর্ভিক্ষের চিত্র পাওয়া যায়।
পোষস্বপ্ন:
গল্পের মকু দুর্ভিক্ষের কারণে গ্রামের বাড়ি বন্ধক রেখে স্বামীসহ শহরে যায়।
স্বামীর মৃত্যুতে সে দেহ বিক্রি করে বেঁচেছিল । পৌষে গ্রামে ঋণ পাওয়া যাবে ভেবে
ফিরে আসে। কিন্তু গ্রামে তখনও হাহাকার চলছে। বন্ধকী বাড়ি দখল করে নিয়ে মালিক
মকুর দেহ ভোগ করতে চায়। গ্রামে তার সবাই চিনে বলে রাজি হয় না। পরবর্তীতে
তালুকদারের জবরদস্তির শিকার হয়ে সে গ্রাম ত্যাগ করে ।
অনেক
দিনের আশা: এই গল্পে চোর আইনুদ্দিনের পুলিশের
দেওয়া চোর নাম ফুটানোর জন্য ফুলজান মাতব্বরের কাছে দেহ বিসর্জন দেয় আইনুদ্দিনের
সঙ্গে দাম্পত্য জীবনযাপনের আশায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখে আইনুদ্দিন অন্য এক
নারীকে নিয়ে আছে । গ্রামীণ বাস্তবতায় কিশোরীর প্রণয় দক্ষতার সাথে অঙ্কন করেছেন
লেখক এই ‘অনেক দিনের আশা' গল্পে।
পথ
জানা নেই: পথ জানা নেই গল্পে দেখা যায় গ্রামের
মধ্য দিয়ে নতুন রাস্তা নির্মিত হওয়ায় যোগাযোগ সুবিধা হল। কিন্তু এ রাস্তা দিয়ে
গ্রামে প্রবেশ করল চুরি, ছিনতাই, অনৈতিকতা। গফুর আলীর বৌকে এই পথ দিয়ে শহরে নিয়ে
যায় একজন। উন্মাদ গফুর আলী তাই রাস্তা কাটতে শুরু করে।
সাহের বানু: সাহের
বানু গল্পে এক দরিদ্র যুবক ও এক ধনী যুবক উভয়ই সাহের বানুকে পেতে চায়।
প্রতিযোগিতায় নেমে দরিদ্র যুবকটি সাহের বানুকে কিছু দেওয়ার জন্য ক্যাশবাক্স চুরি
করতে গিয়ে ধরা পড়ে। তার আঘাতে ছোট একটি মেয়ে মারা যায় এবং পালাতে গিয়ে পুকুরে
বর্শাবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ।
গ.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের
‘দুধেভাতে উৎপাত' গল্পগ্রন্থের ‘দুধেভাতে উৎপাত’ ও ‘পায়ের নিচে জল’ গল্পে এবং
‘দোজখের ওম' গল্পগ্রন্থের ‘কীটনাশকের কীর্তি’ গল্পে গ্রামীণ জীবন লক্ষণীয়।
পায়ের
নিচে জল: গল্পে আতিক তার বাড়িকে তিনতলা করার জন্য বড় ভাইয়ের
গুলশানের প্লটে বাড়ি বানানোর জন্য গ্রামের জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। আলতাফ
মৌলভীর ছেলেদের আয়ে রমরমা অবস্থা বলে জমি কিনতে রাজি হয়। ফলে বর্গাচাষিদের জমি
চষা বা জমিকেনার উপায় থাকে না। ভূমিহীন বর্গাচাষি আকালু দেশের সমাজ ব্যবস্থাকে
প্রচণ্ড ব্যাঙ্গের কষাঘাতে জর্জরিত।
দুধেভাতে
উৎপাত: দুধেভাতে উৎপাত গল্পে ধারকরা আধমণ চাল শোধ করতে না পারায়
জয়নবের দুধাল গাইকে হারুনমৃধা নিয়ে যায়। অসহায় কঙ্কালসার জয়নবের দুধভাত
খাওয়ার সাধ হয়। ছেলে দুধ কিনতে গিয়ে নাজেহাল হয়। তারপর দুধভাত খেতে গিয়ে
ছেলেমেয়েদের করুণ মুখগুলো তার দুঃখ ও রোগের নতুন উপসর্গ হয়ে দেখা দেয়। প্রচণ্ড
বমির তোড়ে ভেসে যায় দুধভাত খাওয়ার সাধ ।
কীটনাশকের
কীর্তি: কীটনাশকের কীর্তি গল্পে রমিজের অবলা বোনকে অবস্থাসম্পন্ন
হাফিজউদ্দীন নষ্ট করে । পরে হাফিজের সাথে বোনের বিয়ে হয়, কিন্তু হাফিজ সংসার
করতে রাজি না হওয়ায় রমিজের বোন আত্মহত্যা করে। রমিজ তার বড়লোক সাহেবের মেয়ের
মাঝে বুবুর আদল দেখতে পেয়ে বড়লোক জাতের প্রতি তীব্র ঘৃণা বশত তাকে হত্যার চেষ্টা
করে ব্যর্থ হয় । রমিজের বুবু আমিনুন্নেসার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গ্রামের শ্রেণী
শোষণের চিত্র ফুটে উঠেছে।
আখতারুজ্জামান
ইলিয়াসের এসব গল্পগুলোর মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে গ্রামীণ জীবন বাস্তবতা ও শোষণের
নানাবিধ রূপ । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অধিকাংশ সময় নগরে কাটালেও গ্রামীণ জীবনের কথা
ভোলেন নি ।
আলোচনার পরিশেষে
এসে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উক্ত তিন লেখকের গল্পসমূহে গ্রামীণ
মানুষের সীমাহীন দুঃখ দারিদ্র ক্ষুধার পীড়ন, প্রণয় ও তার ব্যর্থতা সামন্ত প্রভুর
অত্যাচার নারী লালসা ও নির্যাতন প্রভৃতি রূপায়িত হয়েছে। গ্রামীণ জীবন বাস্তবতার
রূপায়ণে তাদের দক্ষতা অতুলনীয়।