ভূমিকা : কাজী
নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও শিল্পসাহিত্য অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্রিটিশ
ঔপনিবেশিক যুগে পদানত ভারতে তার আবির্ভাব। অগ্নিবীণা হাতে তার প্রবেশ, ধূমকেতুর
মতো তার প্রকাশ। তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন,
প্রকাশ করেন ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দি হলে লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী'।
এখানে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার জন্য স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত সৈনিক
হিসেবে বিদ্রোহের কথা বলেছেন ।
কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় বিদ্রোহী
দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার রচনার মূল
বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের
বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। ‘ধূমকেতু' পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল 'ধূমকেতু'
নামে যে কবিতা লিখেছিলেন, তাতে তিনি বলেছেন, “আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ
মহাবিপ্লব হেতু/এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।” মূলত নজরুল ব্রিটিশ সরকারের
'শনি' রূপেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। আনন্দময়ীর আগমনে' শীর্ষক কবিতার জন্য তিনি
ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনের ১২৪-ক ধারা অনুসারে রাজদ্রোহের অপরাধে গ্রেফতার হন । তখন
আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি আদালতে একটি জবানবন্দি পেশ করেন। এ জবানবন্দিই পরবর্তীতে
‘রাজবন্দীর জবানবন্দী' শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ জবানবন্দিতে
তিনি নিজেকে ভগবান নির্দেশিত সত্যের সেবক বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন যে, তিনি
সত্য প্রকাশের যন্ত্র। ভগবান তাকে উৎপীড়িত আর্তমানবতার পক্ষের তরবারি হিসেবে
পাঠিয়েছেন । তিনি তার কবিতা ও নিবন্ধে যে বিদ্রোহের বাণী উচ্চারণ করেছেন তা
ভগবানের নির্দেশেই করেছেন। তার এ বিদ্রোহ রাজার বিরুদ্ধে নয়; বরং তা অন্যায়ের
বিরুদ্ধে। এ বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তিনি বিদ্রোহ করেছেন
ইংরেজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কারণ তখন ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষে অন্যায়
অত্যাচার এবং অনাচারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল । তাদের দুঃশাসনে পরাধীন ভারতবাসীর
নাভিশ্বাস ওঠে। তিনি মনে করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, বিদ্রোহ করা অপরাধ নয়
। তাছাড়া তিনি যা বলেছেন তা রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে
তা সত্যদ্রোহী নয়। ভগবান অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের তরবারি দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন
অপ্রকাশিত সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। সুতরাং তাকে রাজদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করা
অন্যায়। তিনি রাজার বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ করেননি, তার বিদ্রোহ সকল অন্যায়,
অত্যাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে। এবং তিনি স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত সৈনিক হিসেবে
সাধ্যানুযায়ী দায়িত্ব ও আদেশ পালন করেছেন ।
উপসংহার : নজরুল
মনে করেন, রাজার নিযুক্ত রাজ অনুবাদক রাজভাষায় তার বাণীর শুধু ভাষাকে আক্ষরিক
অনুবাদ করেছে, ভাবানুবাদ করেনি। এজন্য এ অনুবাদে রাজবিদ্রোহ ফুটে ওঠেছে। তাছাড়া এ
অনুবাদের উদ্দেশ্য ছিল রাজাকে সন্তুষ্ট করা । কিন্তু কবির লেখায় ছিল অন্যায়ের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার মন্ত্র । এখানে কোনো
ব্যক্তি বিশেষের প্রতি বিদ্রোহ ছিল না।
***২***
কাজী
নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা ভাষা ও
সাহিত্যে বিপ্লবের দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের তলে পদানত
ভারতে তার আবির্ভাব ঘটে বিদ্রোহী চেতনার পতাকাবাহী হিসেবে। তার সাহিত্যকর্মে
বিদ্রোহ, মানবমুক্তি, এবং সমাজের প্রতি তার গভীর দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটে।
নজরুল
ইসলামকে বিদ্রোহী কবি নামে অভিহিত করা হয় তার সাহসী, প্রতিবাদী ও বিপ্লবী রচনার
কারণে। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কেবল কবিতার মাধ্যমে নয়, বরং কর্মের মাধ্যমেও
প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার সম্পাদিত সাময়িকী ‘ধূমকেতু’
ছিল সেই প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের
বিরুদ্ধে জাগরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার কবিতা ‘ধূমকেতু’-তে তিনি উচ্চারণ করেন,
“আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব
হেতু/ এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।”
এ বক্তব্যে তিনি নিজেকে সমাজ ও শাসনের অন্যায়, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক
মহাবিপ্লবের দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নজরুলের
সাহিত্যকর্মের অন্যতম আলোচিত সৃষ্টি হলো ‘রাজবন্দীর
জবানবন্দী’, যা তার অদম্য প্রতিবাদী চেতনাকে ধারণ করে। ১৯২৩ সালে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য
ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজদ্রোহের (আইন
১২৪-ক ধারা) অভিযোগে গ্রেফতার করে। আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে
তিনি যে বক্তব্য পেশ করেন, তা ইতিহাসে ‘রাজবন্দীর
জবানবন্দী’ নামে খ্যাত।
এ
জবানবন্দিতে নজরুল নিজেকে “ভগবান কর্তৃক
প্রেরিত সৈনিক” হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, তিনি শাসকের বিরুদ্ধে
নয়, বরং অন্যায়, অত্যাচার ও মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তার
বক্তব্যে উঠে আসে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল আনুগত্য। তিনি বলেন,
“আমি সত্যের সেবক, ভগবান আমাকে আর্তমানবতার
তরবারি হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমার কবিতা ও নিবন্ধে যে বিদ্রোহের সুর বাজে, তা
ভগবানেরই নির্দেশ।”
নজরুল এই বিদ্রোহকে ব্যাখ্যা করে বলেন, এটি কেবল শাসকের বিরুদ্ধে নয়; বরং শোষণ,
নিপীড়ন ও অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে। তিনি স্পষ্ট করেন যে, “রাজদ্রোহ” বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তা
আদতে “সত্যদ্রোহ” নয়।
ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদী শাসনের দুঃসহ জগদ্দল পাথরের মতো ভারতে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ
হয়ে উঠেছিল। শাসকদের জুলুম, শোষণ এবং বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে নজরুলের এই সাহসী
অবস্থান তাকে জনগণের কণ্ঠস্বর করে তুলেছিল। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’-তে নজরুল এও বলেছেন যে, আদালতের
নিয়োজিত রাজ-অনুবাদক তার বক্তব্যের ভাবানুবাদ করেনি; বরং আক্ষরিক অনুবাদে তার
প্রতিবাদকে রাজদ্রোহ হিসেবে চিত্রিত করে।
নজরুলের
বিদ্রোহ কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়; বরং তা সকল প্রকার অনাচার, শোষণ ও
দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। তিনি স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে মানবতার পক্ষে, সত্যের পক্ষে
দাঁড়িয়েছেন। নজরুল বিশ্বাস করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা কখনোই অপরাধ নয়;
বরং তা মানবিক ও নৈতিক কর্তব্য।
কাজী
নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’
কেবল একটি আইনি আত্মপক্ষ সমর্থনের দলিল নয়; এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক মহান
প্রতিবাদ, যা আজও বিদ্রোহী চেতনার মশাল বহন করে। তার এই বক্তব্য শুধু তার নিজের
সময়ের জন্য নয়, বরং সমকালীন ও ভবিষ্যৎ মানবমুক্তির আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণার
উৎস। নজরুল তার প্রতিটি রচনায় যে প্রতিবাদ, বিদ্রোহ এবং মুক্তির ডাক দিয়েছেন, তা
আজও প্রাসঙ্গিক।