ভূমিকা
: ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার তথা বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের
অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে
খ্যাতি পেতে চেয়েছিলেন। এজন্য কঠোর মূল্য দিতে হয়েছিল তাকে। বেঁচে থাকার শেষ দিন
পর্যন্ত তিনি অনুশোচনায় ভুগেছেন, আত্মবিলাপ করেছেন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা
করতে যাওয়ার ভুল প্রচেষ্টার বিষয়ে । ‘আত্ম-বিলাপ' কবিতাটি কবির সে আত্মানুভূতির
লিখিত দলিল ।
বাংলা
কবিতার জগতে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্য চর্চার
প্রাথমিক বছরগুলো সুখের ছিল না । জীবনের প্রথমদিকে মোহগ্রস্ত কবি উপলব্ধি করতে
পারেননি, বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেই শেষ পর্যন্ত খ্যাতি লাভ সম্ভব। এ জন্য
আস্থা হারানো মধুকবি দুঃখ করে বলছেন, আশার ছলনায় ভুলে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা
করতে যাওয়াটা তার ভুল হয়েছিল। এ ভুলের সংশোধন করা বা সেই ক্ষতিপূরণ করা তার
পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ হারানো সময় তিনি ফিরিয়ে আনতে পারবেন না । ঐ ভুলের মাশুল
জোগাতে তিনি দিন দিন আয়ুহীন ও হীনবল হয়েছেন । তবু খুব সহজে তার ঐ নেশা কাটেনি ।
এ মোহ ত্যাগ করে সত্বর তিনি তার সেরা সময় থাকতে থাকতে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য
চর্চা করতে আগ্রহী। সেভাবে তিনি নিজের মনকে প্রস্তুত করেন। তিনি মনে করেন, অলীক
স্বপ্নের সুখ ক্ষণস্থায়ী; মোহ কেটে গেলেই দুঃখের শুরু হয়। তিনি নিজে বাস্তব
অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছেন, বিদেশ বিভুঁইয়ে খ্যাতির আশা মরীচিকার মতো ছলনা।
কারণ তিনি অনেক আশায় বুক বেঁধে স্বদেশের সবকিছু তুচ্ছ করে বিরাট প্রাপ্তির
প্রত্যাশায় অথৈ সমুদ্র সদৃশ অনাগত আগামীর বুকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন । কিন্তু তিনি
বিফল হয়েছেন । শত চেষ্টা করেও কবির অর্থ আসেনি, যশ আসেনি; অর্থনৈতিক কষ্টে
ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, পদ্মফুল সদৃশ খ্যাতি অর্জন করতে গিয়ে বিষধরের দংশনস্বরূপ
আঘাত পেয়েছেন। যশের লোভে নিজের আয়ু ক্ষয় করেছেন, অনাহার, অনিদ্রার কষ্ট ভোগ
করেছেন। মুক্তার লোভে ধীবর যেমন গভীর জলে ডুব দেয়, সাধক যেমন সাধনায় মূল্যবান
জীবন অতিবাহিত করে, তেমনি মুক্তার চেয়েও দামি অমূল্য সময় কবি ব্যয় করেছেন। অথচ
শুধু কষ্ট ছাড়া আর কিছুই তিনি অর্জন করতে পারেননি। এজন্য এখন নিজেকে তিনি ভর্ৎসনা
করছেন আত্মবিলাপের মাধ্যমে ।
উপসংহার
: আত্মবিলাপ মূলত অমিতব্যয়ী জীবনযাপনে অভ্যস্ত মধুকবির হতাশাপীড়িত ও ব্যথাদীর্ণ
হৃদয়ের ভ্রান্তিমোচন । এজন্য খ্যাতি, প্রাচুর্য ও প্রেমের মোহে অন্ধ ঋণগ্রস্ত
কপর্দকহীন বেদনার বালুচরে মরীচিকার হাতছানিতে ক্ষতাক্ত কবিহৃদয়ের মর্মভেদী
উচ্চারণে সমগ্র কবিতার অবয়ব আবৃত । তাই একে বলা যায়, দুঃখের দহনে দগ্ধ কবি
চিত্তের আত্মোপলব্ধির সংকটাপন্ন আত্মবিলাপ ।