কবি ‘ডাহুক' কবিতায় ডাহুকের সুরে কীভাবে আত্মমুক্তির প্রেরণা লাভ করেছেন?

ভূমিকা : বাংলা কাব্য সাহিত্যের অনন্য দিকপাল কবি ফররুখ আহমদ। নজরুল যুগের পর দিগন্ত উন্মোচন করে এ কবির আবির্ভাব। যুগ বিচারে ফররুখ যুগের সৃষ্টি নয়, স্রষ্টা। কাব্য ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ভাবধারার সন্ধান এবং সর্বপ্লাবী সাহিত্যচর্চায় কালোত্তীর্ণ ধারা সৃষ্টিতে তিনিই তার উপমা। 'ডাহুক' তার বিখ্যাত কবিতা। এ কবিতায় কবি ডাহুকের সুরে আত্মমুক্তির প্রেরণা লাভ করেছেন ।

বাংলার এক অপরূপ পাখির নাম ডাহুক । কবিকুল তাকে ভালবাসার নিঃস্বার্থ প্রহেলিকা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। আসলে পাখিটি চিরবিরহী প্রকৃতির। সঙ্গীহীন হলে এরা পাগল হয়ে যায়। ডাহুক হারালে ডাহুকী দিনরাত পাগলের মতো ডাকাডাকি করতে থাকে । তাই কবিতার অলঙ্কার হয়েছে ভীরু, লাজুক, প্রেমিক পাখি ডাহুক। মুসলিম রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ কবি ফররুখ আহমদ রচিত 'ডাহুক' একটি বিখ্যাত কবিতা । এ কবিতায় কবি শুনেছেন অসামান্য তন্ময়তার প্রতিধ্বনি । ডাহুকের ডাকের অশরীরী সুরের মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে জিকিরের গভীর তন্ময়তা। এ প্রতীকের ব্যবহার প্রসঙ্গে কবিকে উদ্ধৃত করে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বলেছেন, “ফররুখ আহমদ বলতেন, তিনি ‘ডাহুক’কে নিঃসঙ্গ সাধকের জিকির এবং তার সাধনার সাফল্যের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। ডাহুক রাতভর ডাকতে ডাকতে গলায় রক্ত তুলে ডিমে তা ছড়িয়ে দিয়ে ওম্ দিলেই নাকি বাচ্চা ফোটে। সাধকের সাধনা এবং সাফল্য অনেকটা ঐ রকমই।” এ সাধনার অনুকরণে কবি বিচিত্র উপমা ও উৎপ্রেক্ষার মধ্য দিয়ে কবি এখানে যে আত্মমুক্তি প্রেরণা লাভ করেছেন, তাকে উপস্থাপনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পৃথিবীময় বেদনাদীর্ণ মানুষের নিঃসঙ্গতা যে অসীম অনন্তের সান্নিধ্য সন্ধ্যানী তারই চিত্ররূপ এ কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি মানুষের হৃদয়কে প্রকৃতির এ বাঙ্ময় আকুতি আলোড়িত করেছে। যেন গভীর এক বিশ্বাসের মধ্যেই মানুষের সে আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি। দিনের কর্মব্যস্ততা, রাত্রির স্বপ্নাচ্ছন্ন পরিবেশ স্বাভাবিকভাবে ঘুমের উদ্রেক করে এবং এই ঘুম মানুষের জগৎকে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু ডাহুক এ মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে, তাকে মানুষের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে। কবির অবস্থান এ দুই বিপরীতের মাঝখানে । এ জন্য কবিকে ঘুম আচ্ছন্ন করতে পারেনি । ঘুমের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গী নেতিবাচক । তিনি জেগে ডাহুকের ডাক শুনছেন। এ ডাক গভীর বন্দর থেকে, সামুদ্রিক অতলতা থেকে উঠে যাচ্ছে ঊর্ধ্বপানে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সাধনার বাণী বহন করে । আর সে বাণীতে কবি আত্মমুক্তির প্রেরণা লাভ করেছেন ।

উপসংহার : এ কবিতায় ডাহুকের ডাক প্রকৃতিকে অতিক্রম করে, মানুষকে উপেক্ষা করে সুরের পিপাসায় উন্মুখ এ শরাবের পেয়ালা মহাশূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। এ ডাক তৃষ্ণাদীর্ণ, এ ডাক অবিশ্রান্ত ও বিষাদময় এবং এর মর্মার্থ হলো পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সাধনার শেষ নেই এবং মিলন সহজ নয় ।


***২***


ফররুখ আহমদ বাংলা কাব্য সাহিত্যের এক অমর নাম, যিনি নজরুল যুগের পর সাহিত্য জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। তিনি ছিলেন কেবল একজন কবি নন, বরং কাব্য ক্ষেত্রে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং নতুন ভাবধারার স্রষ্টা। তার সাহিত্যচর্চা সর্বপ্লাবী, যার মাধ্যমে তিনি কালোত্তীর্ণ ধারা সৃষ্টি করেছেন। 

ফররুখ আহমদের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মুসলিম রেনেসাঁর চেতনা, আত্মমুক্তির প্রেরণা এবং গভীর তত্ত্বচিন্তা। তার রচনায় আধুনিকতার সঙ্গে ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনার মিশ্রণ দেখা যায়। তিনি নিজেকে সময়ের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং তার সৃষ্টি অসীম সময়ের জন্য।

তার বিখ্যাত কবিতা ‘ডাহুক’ এই চেতনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলার এক অদ্ভুত সৌন্দর্যমণ্ডিত পাখি ডাহুককে কেন্দ্র করে রচিত এই কবিতায় তিনি আত্মমুক্তির ধারণা তুলে ধরেছেন। ডাহুক পাখি তার চিরবিরহী প্রকৃতির জন্য পরিচিত। যখন তার সঙ্গী হারিয়ে যায়, তখন সে দিনরাত পাগলের মতো ডাকতে থাকে। এই বিরহ, আকুতি, এবং অনন্ত তৃষ্ণার সুরই ফররুখ আহমদের কাব্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। 

ডাহুকের ডাকের মাধ্যমে কবি নিঃসঙ্গ সাধকের আত্মপ্রকাশ এবং তার জিকিরের তন্ময়তা তুলে ধরেছেন। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ফররুখ আহমদ সম্পর্কে বলেছেন, “ফররুখ আহমদ বলতেন, তিনি ‘ডাহুক’কে নিঃসঙ্গ সাধকের জিকির এবং তার সাধনার সাফল্যের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করেছেন।” ডাহুক পাখির এই সুর যেন এক অন্তর্নিহিত সাধনার প্রতীক। পাখিটি রাতভর ডাকতে ডাকতে নিজের সর্বস্ব নিঃশেষ করে ডিমে প্রাণ সঞ্চার করে। কবি এই সাধনার সঙ্গে মানুষের আত্মিক মুক্তির চেষ্টাকে তুলনা করেছেন।

 ‘ডাহুক’ কবিতায় ফররুখ আহমদ প্রকৃতির সঙ্গীতকে অতিমানবিক এবং আধ্যাত্মিক অর্থে রূপ দিয়েছেন। ডাহুকের ডাক প্রকৃতির সীমানা অতিক্রম করে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষকে এক গভীর তৃষ্ণার অনুভূতিতে নিমজ্জিত করে। কবির দৃষ্টিতে এটি মানব আত্মার পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার এক অবিরাম আকুতি। 

ডাহুক পাখিকে কবি মানুষের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন। মানুষের কর্মব্যস্ততা ও ঘুমের আচ্ছন্নতা যেখানে জীবনের এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য, সেখানে ডাহুক এ দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। কবি নিজে এই দুটি বিপরীত অবস্থানের মাঝখানে অবস্থান করছেনতিনি ঘুমকে প্রত্যাখ্যান করে জেগে ডাহুকের ডাক শুনছেন। সেই ডাক তাকে গভীর এক আধ্যাত্মিকতার পথে নিয়ে যায়। 

ডাহুকের ডাক সম্পর্কে কবি মনে করেন, এটি তৃষ্ণার্ত, অবিশ্রান্ত, এবং বিষাদময়। এই ডাকের প্রকৃত মর্মার্থ হলোপরমাত্মার সঙ্গে মিলন সহজ নয়, কিন্তু সাধনার শেষ নেই। 

‘ডাহুক’ কবিতায় ডাহুক পাখির ডাক নিছক প্রকৃতির কোনো উপমা নয়; বরং এটি মানুষের অন্তর্গত আত্মা, তৃষ্ণা এবং পরমাত্মার সন্ধানের এক মহত্তম প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে কবি গভীর বিশ্বাস ও ত্যাগের প্রেরণা লাভ করেছেন। ডাহুকের ডাক যেন এক চিরন্তন সাধনার প্রতিধ্বনি, যা মানব হৃদয়ে অনন্ত আশার সঞ্চার করে।

ফররুখ আহমদের ‘ডাহুক’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সৃষ্টি। এতে তিনি ডাহুকের ডাকের আধ্যাত্মিক সুরের মাধ্যমে মানুষের আত্মিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছেন। তার প্রতীকী চিত্রকল্প, গভীর তত্ত্বচিন্তা এবং অনন্য প্রকাশভঙ্গি তাকে বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ফররুখ আহমদের এই সৃষ্টি শুধু একটি কবিতা নয়, বরং এটি আত্মসাধনা ও মানবিক মুক্তির প্রতীক হিসেবে চিরকাল প্রাসঙ্গিক থাকবে।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url