ভূমিকা : বাংলা
সাহিত্য জগতে আবুল মনসুর আহমদ অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ব্যঙ্গ গল্পের কৃতী লেখক হিসেবে
তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার রচিত 'আয়না' গল্পগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে
অনন্য সংযোজন । ‘আয়না' গল্পগ্রন্থের ‘হুযুর কেবলা' এ ধরনের এক ভণ্ড পীরের কাহিনিমূলক
গল্প । এ গল্পে এমদাদের অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের পর ধর্ম সম্পর্কে যে মনোভাব
সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
কলেজ পড়ুয়া
এমদাদ দর্শন বিভাগের ছাত্র। সে খোদা, ধর্ম, রাসুল এসব কিছুই মানত না। ধর্মীয়
বিষয় নিয়ে সে সর্বদা ঠাট্টা করতো। কিন্তু খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে এমদাদ
একেবারে পাল্টে যায়। সে মনে করে, দুনিয়ার এসব সৌখিনতা দিয়ে কিছুই হবে না। তাই
সে তার সবগুলো বিলাতি ফিনফিনে ধুতি, সিল্কের জামা পুড়িয়ে ফেলে। ফ্লেক্সের ব্রাউন
রঙের পাম্পশুগুলো বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়ে কুপিয়ে ইলিশকাটা করে। চশমা ও
রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়িয়ে ভেঙে ফেলে। তার ব্যবহৃত ক্ষুর, স্ট্রপ, শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেক দূর রাস্তা হেঁটে
ফেলে দিয়ে আসে। নবির সুন্নাত পালনের জন্য এমদাদ মুখে দেড় ইঞ্চি লম্বা দাড়ি রাখে,
সামনে পিছনে সমান করে চুল কাটে। মাথায় গোল নেকড়ার টুপি পরে। এরকম বেশভূষা ধারণ করে
সে যখন স্বদেশি হয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়, সেদিন রাস্তার অনেক লোক তাকে সালাম
দেয়। তার প্রতি রাস্তার লোকের ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে সে ধর্মের প্রভাব ও অস্তিত্ব উপলব্ধি
করে। সে আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এখনকার আধুনিক সময়ে এসেও মানুষ অনেক ধর্মকর্ম করে। তার
মনে হয় যেখানে একদিন সে নিজে ধর্ম মানত না, খোদার অস্তিত্ব নিয়ে নানারকম প্রশ্ন ছিল,
আজ তার সে বিষয়ে আর কোনো সংশয় থাকল না । রাস্তার লোকদের ধর্মানুভূতি দেখে তার মনে
নতুন অনুভূতি জাগ্রত হয়। এ কলি যুগে এসেও মানুষের মাঝে এমন শ্রদ্ধা, সম্মান, ধর্মানুভূতি
দেখে এমদাদের মনে হয় যে, যুগ পাল্টালেও ধর্ম পাল্টায়নি। কেননা ধর্মের মধ্যে যে পবিত্রতা
আছে, ধার্মিক সবার দ্বারা সম্মানিত হয়— তা সাধারণ লোকদের আচার আচরণ দেখে বুঝা যায়। ফলে এমদাদের ধর্মানুভূতি
আরও মজবুত হয় ৷
উপসংহার : এমদাদ নব্য ধর্মানুসারী। বিগত জীবনে সে ধর্মকর্ম করেনি।
তাই খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের প্রাক্কালে সে যখন নিজেকে পরিবর্তন করে রাস্তায় বের
হয়, তখন তার প্রতি মানুষের এমন শ্রদ্ধাবোধ দেখে সে অভিভূত হয়ে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি
করে ৷
***২***
বাংলা
সাহিত্য জগতে আবুল মনসুর আহমদ এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ব্যঙ্গ ও রম্য সাহিত্যের
মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার রচিত 'আয়না' গল্পগ্রন্থটি
বাংলা সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী সংযোজন। এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পেই সমাজের
অসঙ্গতি, ভণ্ডামি এবং ধর্মীয় কপটতার একটি শক্তিশালী চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, ‘হুযুর
কেবলা’ গল্পটি ভণ্ড পীরের কাহিনিমূলক একটি অসাধারণ রচনা, যা পাঠককে সমাজের
কুসংস্কার এবং ভণ্ডামি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
গল্পের
কেন্দ্রীয় চরিত্র এমদাদ, একজন কলেজ পড়ুয়া দর্শন বিভাগের ছাত্র। সে খোদা,
ধর্ম, এবং রাসুল সম্পর্কে বিশ্বাস করত না এবং এ নিয়ে প্রায়শই ঠাট্টা-তামাশা করত।
তবে খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের পর তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে যায়। তার মনে হয়,
দুনিয়ার বিলাসিতায় কোনো মূল্য নেই, এবং তাই সে নিজের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে। সে
তার বিলাসী জীবনযাপনের সমস্ত উপকরণ—ফিনফিনে
ধুতি, সিল্কের জামা, বিলাতি পাম্পশু, চশমা, রিস্টওয়াচ—সব পুড়িয়ে বা ভেঙে ফেলে। এমনকি, সে
নিজের শেভিং কিটও রাস্তা থেকে বহু দূরে ফেলে আসে। নতুনভাবে জীবনধারণের জন্য এমদাদ
দাড়ি রেখে নবির সুন্নাত পালনের চেষ্টা করে, চুল কাটে এবং মাথায় টুপি পরিধান করে।
এমদাদের
নতুন রূপে রাস্তার লোকেরা তাকে অভিবাদন জানায়, যার মাধ্যমে সে ধর্মের প্রতি
মানুষের গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্মানের বিষয়টি উপলব্ধি করে। আধুনিক যুগেও মানুষের এই
ধর্মানুভূতি এবং ধার্মিক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান দেখে এমদাদ চমৎকৃত হয়। তার মনে
হয়, যুগ যতই পাল্টাক, ধর্মের প্রভাব ও পবিত্রতা রয়ে গেছে একই রকম। ধর্ম সম্পর্কে
তার আগের সংশয় এবং অবিশ্বাস দূর হয়ে যায়। তার প্রতি মানুষের এমন শ্রদ্ধাবোধ দেখে সে অভিভূত হয়ে প্রশ্নোক্ত উক্তিটি
করে ৷ সমাজের সাধারণ মানুষের আচরণ তাকে বোঝায়
যে ধর্মে যে গভীর পবিত্রতা এবং মানবিক মূল্যবোধ রয়েছে, তা যুগ যুগ ধরে মানুষের
জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এমদাদ
গল্পের এক নব্য ধার্মিক চরিত্র, যার পরিবর্তন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সমাজের
আচরণেও প্রতিফলিত হয়। তার নতুন অনুভূতি ও প্রশ্নব্যঞ্জক মনোভাব গল্পের মূল
বিষয়বস্তুকে আরও গভীর করে তোলে। এই পরিবর্তনকে লেখক আবুল মনসুর আহমদ এমন সূক্ষ্ম
ব্যঙ্গাত্মক অথচ প্রাসঙ্গিক রূপে উপস্থাপন করেছেন যে এটি গল্পটিকে শুধু বিনোদনমূলক
নয়, বরং চিন্তাশীলও করে তোলে।
'হুযুর
কেবলা' গল্পটি ধর্মের বাহ্যিক প্রভাব এবং মানুষের চেতনায় এর গভীরতাকে
দেখানোর পাশাপাশি সমাজে প্রচলিত ভণ্ডামি ও কুসংস্কারকে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে প্রকাশ
করেছে। এটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং সমাজের একটি আয়না, যা মানুষকে আত্মবিশ্লেষণের
আহ্বান জানায়।