'যৌবনে দাও রাজটিকা' প্রবন্ধ অবলম্বনে 'দেহের যৌবন' ও 'মনের যৌবন'- এর পার্থক্য নির্দেশ কর ৷

ভূমিকা : প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রুপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে যুগান্তকারী বাঁক পরিবর্তনের সূচনাকারী ও বিদ্রুপাত্মক প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন । তিনি ‘যৌবনে দাও রাজটিকা' প্রবন্ধে যৌবনকে দৈহিক ও মানসিক এ দুভাগে ভাগ করে উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করেছেন ।

 

'দেহের যৌবন' ও 'মনের যৌবন'
প্রমথ চৌধুরী

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক প্রমথ চৌধুরী ‘যৌবনে দাও রাজটিকা' প্রবন্ধে যৌবন বন্দনার স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেহের যৌবনের সঙ্গে মনের যৌবনের পার্থক্য দেখিয়েছেন। উভয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও তিনি উভয়কে স্বতন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রাবন্ধিকের মতে, দেহগত যৌবন হলো সংস্কৃত কবিদের নির্দেশিত ভোগসর্বস্ব যৌবন আর মানসিক যৌবনকে তিনি মনের যৌবন বা প্রকৃত যৌবন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন । লেখকের মতে, মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলে তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। লেখক মনে করেন দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ওপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেহ ও মনের পার্থক্যের উপরই মানুষের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত। দেহ সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ এবং মন উদার ও ব্যাপক। দেহের যৌবনের কোনো সামাজিক বিকাশ ও স্থায়িত্ব নেই। দৈহিক যৌবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেই দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। দৈহিক যৌবন একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানসিক যৌবন নির্দিষ্ট বয়সের ফ্রেমে আবদ্ধ নয়। দেহ নিস্তেজ হলেও মনের যৌবন থাকে তেজোদীপ্ত । মানসিক যৌবন স্থবির সমাজকে সবল ও গতিশীল করে এর উন্নয়ন ঘটায়। এছাড়া দৈহিক যৌবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু মানসিক যৌবন চিরস্থায়ী। দেহের যৌবন মানুষের একান্ত ব্যক্তিক, কিন্ত মনের যৌবন সর্বজনীন, তাই একে সমাজজীবনে সঞ্চারিত করা যায়। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করানো যায় না, কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সারিত করে দেওয়া যায়। কেননা একজনের মনের ভাবধারা অন্যের মনে স্থান লাভ করতে পারে। প্রাণের অফুরন্ত শক্তিতে মানসিক যৌবন বিকাশ লাভ করে, কিন্তু দেহ নিস্তেজ হওয়ার সাথে সাথে দৈহিক যৌবন ফুরিয়ে যায়। দেহের যৌবন ব্যক্তিগত এবং মনের যৌবন সামাজিক। দেহের যৌবন ক্ষণিকের, কিন্তু চেতনাগত বিকাশের মধ্য দিয়ে দৈহিক যৌবনকে মানসিক যৌবনে পরিণত করে সমাজ, দেশ ও জাতিকে বদলে দেওয়া যায় ।

 

উপসংহার : সমাজেনিত্য নতুন ভালোবাসা, নতুন কর্তব্য ও নতুন চিন্তা উদয় হচ্ছে। সমগ্র সমাজের এজীবন-প্রবাহ যে নিজের অন্তরে টেনে নিতে পারবে, তার মনে যৌবনের আর ক্ষয়ের আশঙ্কানেই। এ জন্য প্রাবন্ধিক আধ্যাত্মিকতা বিলাসী জড়িমা জড়িত জীবনের মধ্যে সঞ্চারিতকরতে চান অনন্ত প্রাণ-চেতনার প্রসন্ন দীপ্তি, মুক্ত মনের সহাস্য আলোকের মানসিকযৌবন।

 

***২***

 

প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে বিদ্রুপাত্মক প্রবন্ধ রচনার সূচনা করেন, যা তাকে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন ধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণীয় করে তুলেছে। তার রচিত "যৌবনে দাও রাজটিকা" প্রবন্ধে তিনি যৌবনের দার্শনিক ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ করেছেন, যেখানে দেহের যৌবন ও মনের যৌবনের মধ্যকার পার্থক্য এবং তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে।

যৌবনের দুই প্রকার

প্রবন্ধটিতে লেখক যৌবনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন:

1.    দেহগত যৌবন

2.    মানসিক যৌবন

দেহগত যৌবনকে তিনি ভোগসর্বস্ব ও সাময়িক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেহের যৌবন হলো এমন একটি জৈবিক অবস্থা, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়। দৈহিক যৌবনের সীমাবদ্ধতা এবং এর ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতিকে লেখক গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অন্যদিকে, মানসিক যৌবনকে তিনি প্রকৃত যৌবন বা "মনের যৌবন" হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটি চিরন্তন, সীমাহীন এবং সমাজজীবনে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানসিক যৌবনের সঙ্গে সৃষ্টিশীলতা, নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তি যুক্ত, যা ব্যক্তি ও সমাজের বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখে। লেখক মনে করেন, মনের যৌবন একটি চিরস্থায়ী প্রজ্ঞার প্রতীক, যা দেহের নিস্তেজতার পরেও তেজোদীপ্ত থাকে।

দেহ ও মনের সম্পর্ক

প্রমথ চৌধুরী দেহ ও মনের সম্পর্ককে অবিচ্ছেদ্য মনে করলেও তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তার মতে,

দেহের যৌবন যেমন নিজের মধ্যে আবদ্ধ, তেমনি তা অন্য কারো মধ্যে স্থানান্তরিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু মনের যৌবনের ভাবধারা লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। এটি সমাজজীবনের গতিশীলতা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

লেখকের মতে, মানসিক যৌবন সমাজে নিত্য নতুন ভালোবাসা, কর্তব্য ও চিন্তার উদ্ভব ঘটায়। এ ধরনের মানসিক যৌবনই স্থবির সমাজকে প্রগতিশীল করে এবং ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে পরিবর্তন আনে। লেখক তার লেখায় আধ্যাত্মিকতার প্রসন্ন দীপ্তি এবং মুক্ত মনের উদারতা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।

"যৌবনে দাও রাজটিকা" একটি অনুপ্রেরণাদায়ক রচনা, যা ব্যক্তির আত্মিক ও মানসিক উন্নয়নের আহ্বান জানায়। এটি সমাজের উন্নয়নে মানসিক যৌবনের গুরুত্বকে বিশেষভাবে তুলে ধরে। লেখক দেখিয়েছেন, দৈহিক শক্তি যতই ক্ষীণ হোক না কেন, মনের শক্তি ও চিন্তারাজ্যের বিকাশ ব্যক্তি ও সমাজকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে।

এই প্রবন্ধটি বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে বিদ্রুপাত্মক, দার্শনিক এবং সমাজভাবনার এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত হিসেবে চিরস্মরণীয়।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url