“তবে কি আমার বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহিদ মিনার হয়ে যাবে?” – ব্যাখ্যা কর ।

ভূমিকা : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তুখোড় তরুণ কবি শামসুর রাহমান সেই বর্বরোচিত হত্যার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করে কবিতা লিখে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সেই জাতীয় চেতনারই বর্ধিত ও চূড়ান্ত পরিণতি। এ পর্বেও শামসুর রাহমান সমান সক্রিয় ছিলেন। গণআন্দোলন, স্বদেশ চেতনা, মধ্যবিত্তের পরাজয়, অভ্যুত্থান, যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধোত্তর সময়ের অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানকে তিনি মুদ্রিত করেছেন তার কবিতায় ।

তবে কি আমার বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে
তবে কি আমার বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষের নির্মম আত্মত্যাগের বহমান ধারার প্রতি লক্ষ করে কবি শামসুর রাহমান ‘বার বার ফিরে আসে' কবিতায় আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন শহিদে শহিদে ছেয়ে যাবে কি না স্বপ্নের এদেশ, শহিদ মিনারে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে কি সমগ্ৰ জনপদ। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ন্যায়ের সংগ্রামে চলেছে স্বৈরশাসকের রক্তের হোলিখেলা। ১৯৫২ সালে ভাষার বেদিমূলে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে রক্ষা করার জন্য তৈরি হয় শহিদ মিনার। আমরা প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে শোকসংগীত গাইতে গাইতে শহিদ মিনারে যাই এবং ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। কারণ তারা জীবন দিয়ে আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছেন। শহিদ মিনার আজ কেবল একুশের ভাষা আন্দোলনের পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; আমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য দলে দলে লোক সমবেত হয় শহিদ মিনারের সামনে। শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের কোনো বরেণ্য ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটলে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু সময় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা হয়। এভাবে শহিদ মিনার আজ আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শহিদ মিনার আমাদের জীবনে প্রতিটি আন্দোলনের প্রেরণার প্রতীক হিসেবে গভীর তাৎপর্য বহন করে। কারণ ভাষা আন্দোলনের পর থেকে এদেশবাসীকে লড়তে হয়েছে বার বার। আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন, ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । এ আন্দোলনগুলোতে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে, এদেশের মানুষকে রক্তগঙ্গা পাড়ি দিতে হয়েছে। এসব ত্যাগের প্রতিটিতে উপলক্ষ করে যদি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়, তবে সমগ্র দেশ শহিদ মিনারে ছেয়ে যাবে, সমগ্র দেশ পরিণত হবে সুবিশাল শহিদ মিনারে ।


উপসংহার : শহিদ মিনার বাঙালির চেতনার মিনার। এ মিনারের দিকে তাকিয়ে আমরা আমাদের কষ্ট দেখি, আমাদের আনন্দ বেদনা দেখি, এ মিনার আমাদের অহংকারের মিনার। একে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় গণজোয়ার। এ গণজোয়ারের প্রাবল্যের কারণ চেতনার উজ্জীবন । এ মিনার আমাদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য পরিমণ্ডলে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে।


***২***


শামসুর রাহমান ছিলেন বাংলা কবিতার অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ জাতির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়ে তার কবিতায় ধরা পড়েছে এক জাগ্রত চেতনা।


১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম প্রকাশ। শামসুর রাহমান সেই আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কবিতায় তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিজের তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন। তার কবিতায় তিনি ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের আত্মদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। বিশেষ করে ‘বার বার ফিরে আসে’ কবিতায় কবি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই স্বপ্নের দেশ কি শহিদে শহিদে ছেয়ে যাবে? শহিদ মিনার কি প্রতিটি গ্রাম ও জনপদে ছড়িয়ে পড়বে?

এই ভাবনা কবির নৈতিক অবস্থানকে স্পষ্ট করেতিনি বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং আত্মত্যাগের মর্মবেদনা তুলে ধরেছেন। শহিদ মিনারকে কেন্দ্র করে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ চেতনা তার কবিতার মূল প্রেরণা।


শহিদ মিনার একুশের ভাষা আন্দোলনের এক চিরন্তন স্মারক। এটি শুধু ভাষার জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক নয়, বরং বাঙালির প্রতিটি ন্যায়সংগ্রামের প্রতীক। আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয়দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধপ্রতিটি পর্যায়ে শহিদ মিনার বাঙালির সংগ্রামী চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কবি শামসুর রাহমান এই প্রতীককে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং তার কবিতায় শহিদ মিনারের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।

শহিদ মিনার বাঙালির জীবনে প্রেরণার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর দিকে তাকালে জাতি তার অতীত সংগ্রাম এবং অর্জনগুলোর স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করে। এখানে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ভাষা শহিদদের স্মরণ করি, কিন্তু এর কার্যকারিতা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। শহিদ মিনার আজ রাজনৈতিক প্রতিবাদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।


শামসুর রাহমানের কবিতা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও একই রকম শক্তিশালী ছিল। তার কবিতায় স্বাধীনতার স্বপ্ন, বেদনাবোধ এবং স্বৈরশাসনের নির্মমতার ছবি আঁকা হয়েছে। এই পর্বে তার কবিতা হয়ে ওঠে সংগ্রামের হাতিয়ার। তার ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতাটি সেই সময়ের বাঙালির স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মত্যাগের চেতনার প্রতিফলন।


শহিদ মিনার বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল ভাষা আন্দোলনের স্মারক নয়, বরং জাতীয় জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এটি প্রেরণার উৎস। শহিদ মিনারে আমরা জাতীয় শোক, আনন্দ ও সংকল্প প্রকাশ করি। এটি বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।


শহিদ মিনার বাঙালির জন্য চেতনার মিনার, যা আমাদের অতীতকে স্মরণ করায় এবং ভবিষ্যতের জন্য পথ নির্দেশ করে। শামসুর রাহমান তার কবিতায় এই শহিদ মিনারের তাৎপর্য ও প্রতীকী শক্তিকে অমর করে তুলেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি সংগ্রামের ইতিহাসে শহিদ মিনার যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনি শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদের সংগ্রামের চেতনায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url