|
শামসুর
রাহমান |
স্বাধীনতার
প্রেক্ষাপট ও বিক্ষোভ : ‘বারবার ফিরে আসে' কবিতায়
কবি ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালিদের আত্মত্যাগের রক্তাক্ত স্মৃতিকে পাঠকের
সামনে তুলে ধরেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭১ সালের
মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি আন্দোলনে বাঙালিদের বীরত্ব উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এসব ভয়াবহ
আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে কবি মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি নিয়ে রচনা
করেছেন ‘বারবার ফিরে আসে' কবিতাটি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই করতে
করতে অনেক বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে ১৯৭১ সালে। তাদের রক্তের বিনিময়ে
স্বাধীনতা এসেছে— স্বাধীন হয়েছে
বাংলাদেশ। কবির অনুভূতিতে তাদের রক্তে রঞ্জিত মাটি যেন আমাদের বিদ্রোহের প্রতীক।
শহিদের আত্মা ও নানা স্মৃতি যেন ‘বারবার ফিরে আসে' এ বিদ্রোহে শামিল হওয়ার জন্য ।
কবির ভাষায়—
“বারবার
ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে
ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে,
ফিরে
আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে ।”
গণআন্দোলন:
১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পর যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে
তা ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। চারদিকে শুরু হয় মিছিল আর মিটিং। ছাত্র মিছিলে
পুলিশের গুলিতে ২০ জানুয়ারি নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ। এ ঘটনার পর পরই
ছাত্রদের গণজমায়েত ও মিছিলের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি। ফলে
নবকুমার ইনস্টিটিউশনের কিশোর ছাত্র মতিউর রহমান মারা যায়। তাই কবি ‘বারবার ফিরে
আসে' কবিতায় রক্তাপ্লুত আসাদের শার্টকে স্মরণ করেছেন । কবির ভাষায়—
“হাওয়ায়
হাওয়ায় ওড়ে, ঘোরে হাতে-হাতে,
মিছিলে
পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট
বিষম
দামাল দিনগুলি ফিরে আসে বারবার,
বারবার
কল্লোলিত আমাদের শহর ও গ্রাম ৷”
রাজনৈতিক
আন্দোলন : 'বারবার ফিরে আসে' কবিতায় বর্ণিত আন্দোলন সংগ্রামের
চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। মুক্তি লাভের
চেতনার বিকাশ, জনগণের মধ্যে মুক্তির ধারণা ও স্বরূপটি প্রতিষ্ঠার অংশটি দীর্ঘদিন
ধরে একটু একটু করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের বক্তব্য, চিন্তার প্রকাশ, কর্মসূচি ও
আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। বস্তুত পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর তার চরিত্র ও
কার্যকলাপ এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত স্রোতে বইবার সাথে সাথে এ অংশের
সূচনা হয়। চব্বিশ বছরে তা আস্তে আস্তে পরিপক্বতা অর্জন করে। তাই ‘৫২'র ভাষার
লড়াই, ‘৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬'র ছয়দফার আন্দোলন, '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০ এর
নির্বাচনের কোনোটাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বরং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে
গভীরভাবে সম্পর্কিত । আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্বটির সূচনা হয় ১৯৭১ এর
মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের বিচ্ছিন্ন আক্রমণের মাধ্যমে । এ
আন্দোলনগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য পরিমণ্ডলে বিরাট
প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে ‘বারবার ফিরে আসে' কবিতায় এর প্রভাব ও প্রসার
ঘটে ব্যাপকভাবে। '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহিদ আসাদের রক্তাপুত শার্ট স্মরণে
শামসুর রাহমান এ কবিতায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের মূলমন্ত্রকে ছেঁকে তুলে
আনতে চেষ্টা করেছেন । আসাদের রক্তাক্ত শার্ট পরিণত হয় মুক্তির পতাকায়। এরই
প্রেক্ষাপটে কবি লিখেন, “মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট'। কবি মনে
করেন, আসাদের রক্তে ভেজা এ শার্টই যুগের প্রয়োজনে মুক্তি আর ত্যাগের শ্লোগানে
উজ্জীবিত হতে শিখিয়েছে এ বাংলার মানুষকে । তাদের রক্তের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে
যায় সব অপশাসন, শোষণের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল ।
সামাজিক
উপাদান : '৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহিদ আসাদের রক্তাপ্লুত শার্ট
স্মরণে শামসুর রাহমান এ কবিতায় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের মূলমন্ত্রকে ছেঁকে
তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন। এ কবিতায় তিনি নিজেকে একজন যোদ্ধা বা বন্দি হিসেবে
দেখেননি; দেখেছেন কবি হিসেবে। আর সেজন্য এ কবিতার শরীরে, মাংসে রক্তে ধরা পড়েছে
প্রতিবাদী বুলেটবিদ্ধ হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা। দেশমাতার দুর্দিনে কোনো খাঁটি
দেশপ্রেমিক স্থির থাকে না। অবস্থা উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কোনো দেশ-
প্রেমিকের সামনে দেশের ক্ষতি হলে তারা প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি
জীবনও দিতে হয় তাতেও তারা প্রস্তুত। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবাদকাল। এ কালে জাগরণ ও আন্দোলন, প্রতিবাদ ও
প্রতিরোধের যে কাব্য প্রতীতি গড়ে ওঠে, শামসুর রাহমানের এ কবিতায় ঔপনিবেশিকতার
পৌনঃপুনিকতার প্রশ্নে তার অবস্থানের প্রাথমিক সাক্ষী । জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের
মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের
স্বাধীনতা, কারারুদ্ধ নেতাকর্মীদের মুক্তি, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ
এগারো দফার ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি দাবি দিবস' পালনে শাসকগোষ্ঠী বাধাদান
করলে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি আসতে থাকে। ২০ জানুয়ারি ছাত্র-পুলিশ
সংঘর্ষে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান শহিদ হন। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বিস্ফোরণে পরিণত
হয় এবং ২৪ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকা শহরে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সূচিত হয়। আসাদের
রক্তাক্ত শার্ট পরিণত হয় মুক্তির পতাকায়। এরই প্রেক্ষাপটে কবি লিখেন, ‘আমাকেই
হত্যা করে ওরা, ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে'। কবি মনে করেন, আসাদের রক্তে ভেজা এ
শার্টই যুগের প্রয়োজনে মুক্তি আর ত্যাগের স্লোগানে উজ্জীবিত হতে শিখিয়েছে এ বাংলার
মানুষকে। তাদের রক্তের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে যায় সব অপশাসন, শোষণের পুঞ্জীভূত
জঞ্জাল ।
সাংস্কৃতিক
উপাদান : ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ সালেই প্রমাণিত
হয়, এ স্বাধীনতায় বাঙালিদের কোনো সার্থকতা নেই। কারণ, উর্দুকে পাকিস্তানের
রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু এদেশের সংগ্রামী জনগণ তা মেনে নিতে পারেনি। ফলে ভাষা আন্দোলন
শুরু হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য জীবন দিয়ে বাঙালিরা এক
নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। এ সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ ধরেই ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন, ১৯৭০
সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে এবং বাংলাদেশ
স্বাধীনতা লাভ করে ।
উপসংহার
: শামসুর রাহমান সমাজসচেতন এবং দেশপ্রেমিক কবি। তার 'বারবার
ফিরে আসে' কবিতায় চিত্রিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা দেশপ্রেমের কথাই
মনে করিয়ে দেয়। আসাদের রক্তাপ্লুত শার্ট থেকে কবি চিত্তের সংবেদনশীলতাও স্পষ্ট
হয়ে ওঠে । সবকিছু মিলিয়ে ‘বারবার ফিরে আসে' কবিতায় কবির দেশাত্মবোধ উজ্জ্বল
হয়ে উঠেছে ।
***২***
শামসুর
রাহমানের "বারবার ফিরে আসে" কবিতাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের
চেতনাকে গভীরভাবে ধারণ করে। এই কবিতা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১
সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির জাতীয় চেতনাকে জাগ্রত করার প্রতীক হিসেবে
দাঁড়িয়েছে। কবিতাটি একাধারে ইতিহাস, অনুভূতি এবং সংগ্রামের বয়ান।
"বারবার
ফিরে আসে" কবিতায় বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর, বিশেষত
ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা
প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল
শহীদ রফিক, বরকত, সালাম প্রমুখ। তাঁদের আত্মত্যাগ বাঙালির সংগ্রামী চেতনার ভিত্তি
স্থাপন করে। এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের রক্তে উজ্জ্বল হয়েছিল
আন্দোলনের পতাকা, যা ১৯৭১ সালে পূর্ণ স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
কবিতায়
কবি আসাদের রক্তাক্ত শার্টকে একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। এই শার্ট
শুধু একটি শহীদের স্মারক নয়, এটি বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ এবং মুক্তির অনুপ্রেরণার
চিত্র। কবির ভাষায়
“মিছিলে পতাকা হয় বারবার রক্তাপ্লুত শার্ট।”
এই
কবিতায় উঠে এসেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে সংঘটিত কোনো ঘটনা নয়। এটি ছিল
একটি দীর্ঘ সংগ্রামের ফলাফল, যার শিকড় প্রোথিত ছিল ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন,
ছয় দফা দাবি, গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ে। কবি এই ধারাবাহিকতা
বোঝাতে প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন।
“বারবার
ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিসর্গে ফিরে আসে।”
এখানে
"রক্তাপ্লুত শার্ট" একদিকে শহীদের আত্মত্যাগের প্রতীক, অন্যদিকে তা
বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের এক ঐতিহাসিক স্মারক।
"বারবার
ফিরে আসে" কবিতার মূল থিম হলো বাঙালির আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম এবং শোষণের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কবি এই কবিতায় একদিকে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের স্মৃতিচারণ
করেছেন, অন্যদিকে এগুলো থেকে উদ্ভূত চেতনা ও অনুপ্রেরণাকে তুলে ধরেছেন। ১৯৬৯ সালের
গণঅভ্যুত্থান ও আসাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি লিখেছেন—
“আমাকেই হত্যা করে ওরা, ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে।”
এখানে
কবি নিজেকে জনগণের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম করেছেন। কবির মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত
জীবন আর জাতীয় জীবনের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই।
শামসুর
রাহমানের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতীকী ভাষার ব্যবহার। "বারবার ফিরে
আসে" কবিতায় রক্ত, শার্ট, মিছিল, পতাকা ইত্যাদি প্রতীকগুলোর মাধ্যমে তিনি
একটি দৃশ্যমান বাস্তবতা তৈরি করেছেন। ভাষার সরলতা, তীব্র আবেগ, এবং চিত্রকল্পের
মাধ্যমে কবি পাঠকের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন।
"বারবার
ফিরে আসে" কবিতা বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি
শুধুমাত্র আন্দোলন ও আত্মত্যাগের স্মারক নয়, এটি স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার
প্রতীক। কবি শামসুর রাহমান এই কবিতার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসা, শহীদদের প্রতি
শ্রদ্ধা এবং বাঙালির আত্মত্যাগের ইতিহাসকে অমর করে তুলেছেন। কবিতাটি যেমন
শিল্পসুষমায় ভরপুর, তেমনই এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা সংগ্রামের
মূল্য অপরিসীম।
এই
কবিতার মাধ্যমে কবি এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, যেখানে ইতিহাস, শিল্প, এবং
চেতনাকে একত্রিত করা হয়েছে। "বারবার ফিরে আসে" তাই শুধু একটি কবিতা
নয়, এটি বাঙালির সংগ্রাম ও জয়ের প্রতীক।