ভূমিকা :
শামসুর রাহমান তার সমকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। সমাজকে তিনি অনুভব করেছেন
সংবেদনশীল মন দিয়ে । তার কাব্যে স্বদেশপ্রেম প্রাধান্য লাভ করেছে। ‘বারবার ফিরে
আসে' কবিতায় তিনি যুগে যুগে বাংলাদেশের মানুষের নানা আন্দোলনকে চিত্ররূপ
দিয়েছেন। আন্দোলন করতে গিয়ে মানুষের জীবনে যে করুণ পরিণতি এসেছে, এ প্রসঙ্গে কবি
তার অনুভবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন 'বারবার ফিরে আসে' কবিতায় ।
কবির অনুভব :
কবি স্বদেশকে ভালোবাসেন। অত্যন্ত প্রখর দৃষ্টি ও সংবেদনশীলতা দিয়ে তিনি অনুভব
করেছেন দেশকে। দেশের মানুষ, প্রকৃতি কবির আত্মার অবিনাশী অস্তিত্বে দীপ্যমান।
‘বারবার ফিরে আসে' কবিতায় কবি যুগে যুগে বাঙালির আন্দোলনমুখর জীবন ও শাসকগোষ্ঠীর
নিষ্ঠুর নির্মম নির্যাতনের এক বাস্তবচিত্র অঙ্কন করেছেন । বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে
কবি বাঙালির সংগ্রামী মুহূর্তগুলোর এক অনুভবময় আলেখ্য তুলে ধরেছেন এ কবিতায় ।
১৯৪৭ সালের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশ শোষণমুক্ত হয়নি। পাকিস্তান
স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রভাবে পূর্ববাংলায় পরিকল্পনা অনুযায়ী
এক বঞ্চনার ইতিহাস গড়ে ওঠে । কায়েমি স্বার্থবাদী নেতারা এদেশের মানুষকে লাঞ্ছিত
করে ।
কবির আত্মগত ভাবনা
: যুগ যুগ ধরে এ দেশের নিরীহ জনতা বিদেশি শাসন ও শোষণের
জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হয়েছিল । কিন্তু তারা তো দমবার পাত্র নয়। তাই তারা
প্রতিবারই এর প্রতিবাদ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আর এতে স্বৈরশাসক
গোষ্ঠী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। গ্রেনেডে আর বুলেটে, জেল-জুলুম-হুলিয়া দ্বারা, চরম
জবাব দিয়েছে স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল মানবতাকে । তাই কবির ভাবনা স্বৈরশাসক
গোষ্ঠী যুগের পর যুগ নবনব রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হয়; চালায় নির্মম শোষণ। এ
যন্ত্রদানবদের কবল থেকে বাঁচার তাগিদে মানুষকে হানতে হবে চরম আঘাত। কিন্তু সব
আঘাতের জবাবেই যদি শাসকগোষ্ঠী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে । তাই কবির জিজ্ঞাসা-
“তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?”
যুগের রক্তাক্ত
ঘটনাপ্রবাহ : পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা এদেশের
গণমানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল । বাংলার পরিবর্তে তারা উর্দুকে একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। এতে বাংলার ছাত্রসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ তীব্র আন্দোলনে
ফেটে পড়ে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার স্বাধীনতাকামী
বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল মিছিলে শাসকেরা নগ্ন হামলা চালায়। আড়াই হাজার রাউন্ড
গুলির আঘাতে রক্তের ভাষার জন্য স্বর্ণাক্ষরে নাম লিখে যায় সালাম, বরকত, আব্দুল
জব্বার, রফিক উদ্দিন আহমদসহ নাম না জানা অনেকে । আহত হয় অনেক মানুষ । কবির ভাষায়—
“আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে।”
ভাষার দাবি আদায় করেই বাঙালি চুপ করে বসে থাকেনি। ১৯৬৯ সালে
বাঙালি গণআন্দোলনে মেতে ওঠে। ৬ দফা ও ১১ দফার দাবিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার জনপদ ।
বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র, রাজনৈতিক
নেতাকর্মীদের মুক্তি, আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আবারো
বাঙালি রাজপথে নেমে পড়ে, গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন । শহিদ আসাদুজ্জামানের রক্তে
ভেজা শার্ট মুক্তিকামী মানুষকে বারবার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তোলে । কবির
ভাষায়—
“আমাকে হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে।”
‘৬৯ এর গণজোয়ারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই তারা ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালের রাতে নিরীহ বাঙালির ওপর
নগ্ন হামলা চালায় । এরই প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ৯ মাসের অবিরাম যুদ্ধের শেষে অর্জিত হয়
লালসবুজের স্বাধীন পতাকা—
“একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই
আমাকেই হত্যা করে ওরা
পথের কিনারে
এভেন্যুর মোড়ে
মিছিলে, সভায়।”
এ আত্মত্যাগ ১৯৫২ হতে ১৯৭১ এর আত্মত্যাগের এক
মহামিছিল। কেবল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, আসাদ কিংবা বীরশ্রেষ্ঠ ৭ সেনানীই নয়;
বরং লাখো সন্তানের আত্মত্যাগের ফসল এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ।
মানবিক
মূল্যবোধের করুণ পরিণতি : উনিশ শো
উনশত্তর সালে খুনে রঞ্জিত হয়েছে প্রতিটি জনপদ। প্রতিদিন সন্ধ্যা ফিরে আসে কিন্তু
খোকা ফিরে না । অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রতীক্ষার প্রহর গুণে মা ক্লান্ত হয়ে যান,
স্বামীহারা বধূর হৃদয় খাঁক হয়ে যায়, বিধবার বেশ ধরে দুর্বার বেদনার হাহাকারে
বাকরুদ্ধ হয় অভাগা বধূ। কবর খুঁড়ে হৃদয়ের ধন কফিনে সাজিয়ে পিতা হত-বিহ্বলভাবে
তাকিয়ে রয় । কাঁচামাটির সিক্তগন্ধ শেষ হবার পূর্বেই চোখের আড়াল হয় আরেক পিতার
সন্তান । হায়েনার ছোবলে মা-বোনদের ইজ্জত হয় লুণ্ঠিত । এত ত্যাগের বিনিময়েই
মুক্তি পায় বাংলার জনসাধারণ, দূর হয় সকল ষড়যন্ত্র । আর কেঁদে ওঠে মানবতা । কবির
ভাষায়
“একটি মায়ের চোখ থেকে
করুণ প্লাবন মুছে যেতে না যেতেই
আরেক মায়ের চোখ শ্রাবণের অঝোর আকাশ হয়ে যায় ।
একটি বধূর
সংসার-উজাড়-করা হাহাকার থামতে না থামতেই, হায়,
আরেক বধূর বুক খাঁ-খাঁ গোরস্থান হয়ে যায়।”
উপসংহার
: কবি ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে
যেসব সংগ্রাম, আন্দোলন, অনাচার, অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সবই
অনুভবে ধারণ করে কবিতায় রূপ দিয়েছেন এবং কবিতাকে করে তুলেছেন চেতনাকে জাগ্রত
করার এক শক্ত হাতিয়ার। ‘বারবার ফিরে আসে' কবিতাটি বাঙালির মাতৃভাষা ও স্বাধিকার
আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস । সে ইতিহাস একদিকে
যেমন ত্যাগের, সংগ্রামের, অন্যদিকে তেমনি অমানবিক নির্যাতন ও নিষ্ঠুর হত্যার।
বারবার একই পরিণতি ফিরে ফিরে আসে ।
*** ২ ***
শামসুর রাহমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, যিনি তার সংবেদনশীল মন ও প্রখর দৃষ্টিশক্তি দিয়ে সমাজ ও জাতির যন্ত্রণা, সংগ্রাম এবং প্রত্যাশাকে কাব্যে চিত্রায়িত করেছেন। তার কাব্যে স্বদেশপ্রেম একটি প্রধান উপজীব্য বিষয়। ‘বারবার ফিরে আসে’ কবিতায় তিনি বাঙালির ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোকে তুলে ধরে সংগ্রামমুখর জীবন ও শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারের বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরেও পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির প্রত্যেকটি আন্দোলনে শাসকদের নির্মম দমননীতি এবং সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ কবিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। কবিতায় তিনি বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসকে কাব্যময় ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
কবি পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালির মাতৃভাষার ওপর
আঘাত এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিবাদকে চিত্রায়িত করেছেন। ভাষা আন্দোলনের
বীর শহিদদের আত্মত্যাগের স্মরণে তিনি বলেন:
“আমাকেই হত্যা করে ওরা, বায়ান্নোর রৌদ্রময় পথে।”
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতার পরেও বাঙালি
থেমে থাকেনি। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় শহিদ আসাদুজ্জামানের আত্মত্যাগ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের
ইতিহাসকে আরো গৌরবময় করে তোলে। কবি স্মরণ করেন:
“আমাকে হত্যা করে ওরা
ঊনসত্তরের বিদ্রোহী প্রহরে।”
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা
এবং ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় কবির কাব্যে স্পষ্ট
প্রতিফলিত। কবি বলেন:
“একাত্তরে পুনরায় হত্যা করে ওরা আমাকেই।”
‘বারবার
ফিরে আসে’ কবিতাটি মূলত বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসের এক সংবেদনশীল চিত্র। এটি ভাষা আন্দোলন
থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত ত্যাগ, সংগ্রাম এবং শাসকদের পৈশাচিক
নির্যাতনের ধারাবাহিক বিবরণ। কবিতায় কবি অত্যাচারিত জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে শাসকদের নিষ্ঠুরতার
প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
কবি মনে করেন, যুগে যুগে শাসকগোষ্ঠী নতুন রূপে
আবির্ভূত হয়ে শোষণ চালিয়েছে। কিন্তু বাঙালি জাতি কখনো দমে যায়নি; প্রতিবাদ করেছে, স্বাধীনতার
জন্য লড়াই করেছে। কবি প্রশ্ন তোলেন, যদি প্রতিবারই মুক্তির সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী হয়, তবে
কি বাংলাদেশ কেবলই একটি শহিদ মিনারের প্রতীক হয়ে থাকবে?
“তবে কি আমার
বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?”
কবিতার এই প্রশ্নে কবি মুক্তিযুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের
মূল্যায়ন করেছেন এবং একটি শোষণমুক্ত, মানবিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।
‘বারবার
ফিরে আসে’ শামসুর রাহমানের একটি অনন্য কাব্যিক সৃজন, যা বাঙালির সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
এটি কেবল একটি কবিতা নয়; বরং এটি জাতির আত্মত্যাগ, ত্যাগের মহিমা এবং শোষণমুক্তি অর্জনের
চেতনার মূর্ত প্রতীক। কবি শাসন, শোষণ, অত্যাচারের বিপক্ষে মানুষের সংগ্রামী মনোভাবকে
উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।