বাংলা বানানের সমস্যা সমাধানের জন্য বহু প্রতিষ্ঠান বা
ব্যক্তি উদ্যোগী হলেও তেমন ফল পাওয়া যায়নি । আমরা এখনো ইচ্ছামতো বাংলা বানান
লিখে থাকি। এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানকল্পে বাংলা একাডেমি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
তারা বাংলা বানানের সমতাবিধানের লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম
প্রবর্তন করে। বাংলা বানানের সমতাবিধানের উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমি যে বানানবিধি
প্রবর্তন করে তাকে প্রমিত বাংলা বানান বলে ।
বানানের নিয়মসমূহ:
১। যেসব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয় শুদ্ধ কেবল সেসব শব্দে ই
বা উ এবং তার কার-চিহ্ন ি ু হবে। যেমন—
কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, চুল্লি, তরণি, ধমনি, ধরণি, নাড়ি,
পঞ্জি, পদবি, পল্লি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, যুবতি, রচনাবলি, লহরি. শ্রেণি, সরণি,
সূচিপত্র ।
২। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না। যেমন— অর্জ্জন, ঊর্ধ্ব, কৰ্ম্ম, কাৰ্ত্তিক, কাৰ্য্য, বার্ধক্য, মূৰ্চ্ছা,
সূর্য্য ইত্যাদির পরিবর্তে যথাক্রমে অর্জন, ঊর্ধ্ব, কর্ম, কার্তিক, কার্য,
বার্ধক্য, মূর্ছা, সূর্য ইত্যাদি হবে ।
৩। সন্ধির ক্ষেত্রে ক খ গ ঘ পরে থাকলে পূর্ব পদের অন্তঃস্থিত
ম্ স্থানে অনুস্বার (ং) হবে। যেমন— অহম্ + কার = অহংকার এভাবে ভয়ংকর,
সংগীত, শুভংকর, হৃদয়ংগম, সংঘটন।
সন্ধিবদ্ধ না হলে ঙ স্থানে ং হবে না। যেমন— অঙ্ক, অঙ্গ, আকাঙ্ক্ষা, আতঙ্ক, কঙ্কাল, গঙ্গা, বঙ্কিম, বঙ্গ, লঙ্ঘন,
শঙ্কা, শৃঙ্খলা, সঙ্গে, সঙ্গী ।
৪। সংস্কৃত ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দের দীর্ঘ ঈ-কারান্ত রূপ
সমাসবদ্ধ হলে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোতে হ্রস্ব ই-কার হয়। যেমন— গুণী— গুণিজন, প্রাণী- প্রাণিবিদ্যা,
মন্ত্রী— মন্ত্রিপরিষদ। তবে এগুলোর সমাসবদ্ধ রূপে ঈ-কারের
ব্যবহারও চলতে পারে। যেমন— গুণী— গুণীজন,
প্রাণী— প্রাণীবিদ্যা, মন্ত্রী— মন্ত্রীপরিষদ
। ইন্-প্রত্যয়ান্ত শব্দের সাথে -ত্ব ও -তা প্রত্যয় যুক্ত হলে ই-কার হবে । যেমন— কৃতী— কৃতিত্ব, দায়ী— দায়িত্ব, প্রতিযোগী— প্রতিযোগিতা, মন্ত্রী— মন্ত্রিত্ব, সহযোগী— সহযোগিতা।
৫। শব্দের শেষে বিসর্গ (ঃ) থাকবে না। যেমন— ইতস্তত, কার্যত, ক্রমশ, পুনঃপুন, প্রথমত, প্রধানত, প্রয়াত, প্রায়শ,
ফলত, বস্তুত, মূলত । এছাড়া নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে শব্দমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জিত রূপ
গৃহীত হবে। যেমন— দুস্থ, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ, নিশ্বাস
।
৬। ই, ঈ, উ, ঊ সব অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র
শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কার-চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। যেমন— আরবি, আসামি, ইংরেজি, ইমান, ইরানি, উনিশ, ওকালতি, কাহিনি, পদাশ্রিত
নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে। যেমন- ছেলেটি, বইটি, লোকটি। সর্বনাম, বিশেষণ,
ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন- এটা কী বই?
কী আনন্দ! কী আর বলব? কী করছ? কী করে যাব? কী খেলে? কী জানি? কী দুরাশা! তোমার কী!
কী বুদ্ধি নিয়ে এসেছিলে! কী পড়? কী যে করি! কী বাংলা কী ইংরেজি উভয় ভাষায় তিনি
পারদর্শী। কীভাবে, কীরকম, কীরূপে প্রভৃতি শব্দেও ঈ-কার হবে। যেসব প্রশ্নবাচক
বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে, সেসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি' হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা
হবে যেমন— তুমি কি যাবে? সে কি এসেছিল?
নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন
৭। বাংলায় এ বর্ণ বা –ে কার দিয়ে এ এবং অ্যা এই উভয় ধ্বনি
নির্দেশিত হয়। যেমন— কেন, কেনো (ক্রয় করো); খেলা, খেলি:
গেল, গেলে, গেছে; দেখা, দেখি; জেনো, যেন । তবে কিছু তদ্ভব এবং বিশেষভাবে দেশি শব্দ
রয়েছে যেগুলোর ্যা-কার যুক্ত রূপ বহুল পরিচিত। যেমন- ব্যাঙ, ল্যাঠা। এসব শব্দে ্যা
অপরিবর্তিত থাকবে। বিদেশি শব্দে ক্ষেত্র অনুযায়ী অ্যা বা ্যা-কার ব্যবহৃত হবে।
যেমন— অ্যাকাউন্ট, অ্যান্ড (and), অ্যাসিড, ক্যাসেট, ব্যাংক,
ভ্যাট, ম্যানেজার, হ্যাট ।
৮। বাংলা অ-ধ্বনির উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ও-র মতো হয়। শব্দ
শেষের এসব অ-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লেখা যেতে পারে। যেমন-- কালো, খাটো, ছোটো, ভালো;
এগারো, বারো, তেরো, পনেরো, ষোলো, সতেরো, আঠারো; ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় শব্দের আদিতেও
ও-কার লেখা যেতে পারে। যেমন— কোরো, বোলো, বোসো ।
৯। শব্দের শেষে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অনুস্বার (ং)
ব্যবহৃত হবে। যেমন— গাং, ঢং, পালং, রং, রাং, সং। তবে
অনুস্বারের সাথে স্বর যুক্ত হলে ঙ হবে। যেমন— বাঙালি, ভাঙা, রঙিন, রঙের । বাংলা ও
বাংলাদেশ শব্দে অনুস্বার থাকবে ।
১০. অতৎসম শব্দ খিদে, খুদ, খুদে, খুর (গবাদিপশুর পায়ের শেষ
প্রান্ত), খেত, খ্যাপা ইত্যাদি লেখা হবে ।
১১. বাংলায় প্রচলিত বিদেশি শব্দ সাধারণভাবে বাংলা ভাষার
ধ্বনি পদ্ধতি অনুযায়ী লিখতে হবে। যেমন- কাগজ, জাদু, জাহাজ, জুলুম, জেব্রা, বাজার,
হাজার। ইসলাম ধর্মসংক্রান্ত কয়েকটি শব্দে বিকল্পে 'য' লেখা যেতে পারে। যেমন-
আযান, ওযু, কাযা নামায, মুয়াযযিন, যোহর, রমযান, হযরত ।
১২. অতৎসম শব্দের বানানে ণ ব্যবহার করা হবে না। যেমন— অঘ্রান, ইরান, কান, কোরান, গভর্নর, গুনতি, গোনা, ঝরনা, ধরন, পরান, রানি,
সোনা, হর্ন। তৎসম শব্দে ট ঠ ড ঢ এর পূর্বে যুক্ত নাসিক্য বর্ণ ণ হয়, যেমন— কণ্টক, প্রচণ্ড, লুণ্ঠন। কিন্তু অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ট ঠ ড ঢ এর আগে
কেবল ন হবে। যেমন— গুন্ডা, ঝান্ডা, ঠান্ডা, ডান্ডা,
লন্ঠন ।
১৩. বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই ।
যেমন— কিশমিশ, নাশতা, পোশাক, বেহেশ্ত, শখ, শয়তান, শরবত, শরম শহর ।
ইংরেজি ও ইংরেজির মাধ্যমে আগত বিদেশি s ধ্বনির জন্য স এবং sh, -sion, -ssion,
-tion প্রভৃতি বর্ণগুচ্ছ বা ধ্বনির জন্য শ ব্যবহৃত হবে। যেমন- পাসপোর্ট, বাস; ক্যাশ;
টেলিভিশন, মিশন, গেশন; রেশন, স্টেশন। যেখানে বাংলায় বিদেশি শব্দের বানান
পরিবর্তিত হয়ে স ছ এর রূপ লাভ করেছে সেখানে ছ এর ব্যবহার থাকবে। যেমন— তছনছ, পছন্দ, মিছরি, মিছিল ।
১৪. বাংলায় বিদেশি শব্দের আদিতে বর্ণবিশ্লেষ সম্ভব নয়।
এগুলো যুক্তবর্ণ দিয়ে লিখতে হবে। যেমন— স্টেশন, স্ট্রিট, স্প্রিং। তবে অন্য
ক্ষেত্রে বিশ্লেষ করা যায়। যেমন— মার্কস, শেকসপিয়র, ইসরাফিল ।
১৫. হস-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন— কলকল, করলেন, কাত, চট, চেক, জজ, ঝরঝর, টক, টন, টাক, ডিশ, তছনছ, ফটফট,
বললেন, শখ, হুক ।
তবে যদি অর্থবিভ্রান্তি বা ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে
হস-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে । যেমন— উহ্, বাহ্, যাহ্ ।
১৬. ঊর্ধ্ব-কমা যথাসম্ভব বর্জন করা হবে। যেমন— বলে (বলিয়া), হয়ে, দুজন, চাল (চাউল), আল (আইল) ।