‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধের মূলভাব এবং অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
কাজী আবদুল ওদুদ মুসলিম সাহিত্যের অগ্রসরমান চিন্তক। বিংশ শতকের দিকে যখন মুসলিম সাহিত্যিকগণ নিজস্ব বৈরী খোলস থেকে বের হতে পারছিলেন না, ভাষার জড়তা থেকে শুরু করে মানসিক জড়তা এদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো তখন কাজী আবদুল ওদুদ মুক্তচিন্তার ঝান্ডা হাতে এগিয়ে আসেন। তিনি রেনেসাঁসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে বাংলার জাগরণে ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।
বাংলার জাগরণ - কাজী আবদুল ওদুদ |
সচরাচর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মতো সেসময়ের অবিভক্ত বাংলাও ছিল মূলত গোঁড়ামি, সামাজিক অসংগতি, ধর্মীয় অনাচার, মানসিক বিকৃতি, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, শিক্ষার নামে উৎপীড়ন, নীলকরদের অত্যাচার, সর্বোপরি একটি শোষিত দেশ। তখনকার ইংরেজ শিল্পপতিদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো ভারতকে তাদের কারখানার সমৃদ্ধ ভান্ডারে পরিণত করা। তাছাড়া ইংরেজরা কলকাতা শহরে যে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেছিলো সেখানেও শিক্ষাগত বৈষম্য বিরাজমান ছিলো। এরকম বৈষম্যমূলক আচরণ এবং ধর্মীয় আচার ও রক্ষণশীলতায় রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগর আঘাত হানেন। ঊনবিংশ শতকের শেশার্ধ থেকে শুরু করে মূলত বিংশ শতকের গোড়া থেকে ভারতবর্ষে কল্পনাতীতভাবে শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার গণজাগরণে আবির্ভাব ঘটে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবাক বিষ্ময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত এ গণজাগরণেরই অমৃত সন্তান। কিন্তু হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক ডিরোজিও নতুন করে গড়তে চেয়েছেন এদেশের অন্তরকে। চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি প্রথমেই উপনিবেশ এবং ফ্রিট্রেডের বিরোধিতা করেন। তারপর ধর্মীয় বৃত্তের বাইরে এসে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের ইউরোপীয় রেনেসাঁর সাথে সংযোগ স্থাপন করে মানবমহিমার উজ্জ্বল জয় ঘোষণা করেন। হিন্দু সমাজে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে অবারিত প্রান্তরের দিকে হাত বাড়ালেও অভিমানী মুসলমানরা পারেনি আত্মঅহমিকায়। এরূপ পরিস্থিতিতে উদারপন্থী মুসলিম বুদ্ধিজীবীর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনদৃষ্টির ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত অবস্থানকে কাজী আবদুল ওদুদ সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করতে রামমোহনের যুক্তিবাদ, রবীন্দ্রনাথে বিশ্বমানবতা তাকে যু্ক্তিবাদী ও মানবতাবাদী হতে উৎসাহিত করেছে। ওদুদ ধর্মের অনুশাসন ও শাস্ত্রকে যুক্তির আলোতে বিবেচনা করে বাঙালি মুসলমানের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তার ব্যাখ্যাত সৃষ্টিধর্ম ছিলো মূলত বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানকে সমন্বয়ধর্মী সামঞ্জস্যসূত্রে আবদ্ধ করার পথনির্দেশ।
মুসলমানগণ ইংরেজি শেখা থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলো। হিন্দু সমাজ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে অবারিত প্রান্তরের দিকে হাত বাড়ায়। ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে তারা অমৃতের সন্ধান লাভ করে। বাঙালি হিন্দু যেন বারুদ হয়ে জমাটবদ্ধ ছিলো। ইংরেজি ভাষায় সওয়ার হয়ে ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের ঢেউ এসে যেন সে বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শুরু হয় বাঙালি জাগরণ।
কাজী আবদুল ওদুদ রচিত ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধটি ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাঙালি সমাজের রেনেসাঁসধর্মী জাগরণের এক অনন্য দলিল। প্রবন্ধে তিনি সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক এবং শিক্ষাগত রক্ষণশীলতার সমালোচনা করে মুক্তচিন্তা ও মানবতাবাদের চর্চার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মুসলিম সমাজ তখন ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তার প্রতি বিমুখ ছিল, যা তাদের প্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল।
অন্যদিকে, হিন্দু সমাজ ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাবে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্পসাহিত্য এবং শিক্ষায় অগ্রসর হয়েছিল। ডিরোজিও, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মনীষীরা এ রেনেসাঁসের অগ্রদূত ছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, ধর্মের গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে যুক্তিবাদ এবং মানবতাবাদের চর্চা করলে মুসলিম সমাজও প্রগতির পথে এগোতে পারবে। তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রবন্ধের মূলভাব হলো—বাংলার জাগরণ একমাত্র সম্ভব মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে সমগ্র বাঙালির স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।
নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
১। ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধের লেখক কে?
উত্তর: কাজী আবদুল ওদুদ।
২। প্রবন্ধে কোন শতকের বাংলার সমাজ চিত্র উঠে এসেছে?
উত্তর: ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের।
৩। কোন গোষ্ঠী ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রসর ছিল?
উত্তর: বাঙালি হিন্দু।
৪। প্রবন্ধে কোন ধরনের জীবনদর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী।
৫। ডিরোজিওর শিক্ষাদর্শনের প্রধান বিষয় কী ছিল?
উত্তর: চিন্তার স্বাধীনতা এবং মানবমহিমার জয় ঘোষণা।
৬। প্রবন্ধে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী বলা হয়েছে?
উত্তর: ইংরেজি শিক্ষা এবং আধুনিক চিন্তা গ্রহণে অনীহা।
৭। ওদুদের দৃষ্টিতে বাংলার জাগরণের উপায় কী?
উত্তর: মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, এবং হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়।
৮। ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধের রচয়িতা কে?
উত্তর: কাজী আবদুল ওদুদ।
৯। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু কী?
উত্তর: বাংলার রেনেসাঁসধর্মী জাগরণ।
১০। মুসলিম সমাজের আত্মপ্রতিষ্ঠায় লেখকের পরামর্শ কী?
উত্তর: ধর্মীয় অনুশাসন যুক্তির আলোতে বিবেচনা করা।
১১। লেখকের মূল বার্তা কী?
উত্তর: মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ, এবং সমন্বয়।
১২। বাংলার মুসলিম সমাজের পিছিয়ে থাকার কারণ কী?
উত্তর: ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ইংরেজি শিক্ষায় অনীহা।
১৩। হিন্দু সমাজের অগ্রগতির প্রধান মাধ্যম কী ছিল?
উত্তর: ইংরেজি শিক্ষা।
১৪। কোন শতাব্দীর বাংলার সমাজ চিত্র উঠে এসেছে?
উত্তর: ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী।
১৫। হিন্দু কলেজের তরুণ শিক্ষক কে ছিলেন?
উত্তর: ডিরোজিও।
১৬। ডিরোজিওর শিক্ষার মূল বিষয় কী?
উত্তর: চিন্তার স্বাধীনতা ও মানবমহিমার জয়।
১৭। রামমোহন রায় কোন বিষয়ে আঘাত হেনেছেন?
উত্তর: ধর্মীয় গোঁড়ামি।
১৮। কাজী আবদুল ওদুদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ধরনের?
উত্তর: যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী।
১৯। লেখক কোন যুগের বাঙালিদের ঐক্য কামনা করেছেন?
উত্তর: ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী।
২০। কোন গোষ্ঠীর শিক্ষাগত বৈষম্যের সমালোচনা করা হয়েছে?
উত্তর: ইংরেজদের।
২১। বাংলার হিন্দুদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার অগ্রগতিতে কারা ভূমিকা রেখেছেন?
উত্তর: রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ।
২২। কোন প্রক্রিয়া বাংলার রেনেসাঁসকে এগিয়ে নিয়েছে?
উত্তর: ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা।
২৩। লেখকের মতে মুসলিম সমাজের মুক্তির পথ কী?
উত্তর: যুক্তির আলোয় ধর্মীয় অনুশাসনের পুনর্বিবেচনা।
২৪। বাংলার হিন্দুদের শিক্ষাগত সাফল্যের প্রতীক কী?
উত্তর: ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান অধ্যয়ন।
২৫। ইংরেজদের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: ভারতকে শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র বানানো।
২৬। ‘বাংলার জাগরণ’ কোন ধরনের রচনা?
উত্তর: প্রবন্ধ।
২৭। রেনেসাঁসের ধারনা কোন দেশ থেকে এসেছে?
উত্তর: ইউরোপ।
২৮। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের গুরুত্ব কোথায়?
উত্তর: বাংলার সার্বিক প্রগতিতে।
২৯। লেখকের দৃষ্টিতে হিন্দুদের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি কী ছিল?
উত্তর: ইংরেজি শিক্ষা ও মুক্তচিন্তা।
৩০। ডিরোজিওর শিক্ষায় প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর: চিন্তার স্বাধীনতা।
৩১। লেখকের মতে মুসলমানদের আত্মহননের পথ কী?
উত্তর: ইংরেজি শিক্ষায় বিমুখতা।
৩২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?
উত্তর: বিশ্বমানবতার চেতনা।
৩৩। কাজী আবদুল ওদুদের দৃষ্টিভঙ্গি কোন দুটি বিষয় থেকে প্রভাবিত?
উত্তর: যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ।
৩৪। লেখকের মতে বাংলার জাগরণ কোন উপায়ে সম্ভব?
উত্তর: মুক্তচিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি।
৩৫। ইংরেজি ভাষার প্রভাব হিন্দু সমাজে কী ছিল?
উত্তর: জ্ঞানচর্চার বিস্তার।
৩৬। লেখকের মতে মুসলিম সমাজ কীভাবে পিছিয়ে পড়ে?
উত্তর: শিক্ষার আধুনিক পথে অনীহা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি।
৩৭। কোন যুগে বাংলায় গণজাগরণ ঘটে?
উত্তর: ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে।
৩৮। ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধের কেন্দ্রীয় থিম কী?
উত্তর: ধর্মনিরপেক্ষ জীবনদর্শন।
৩৯। রেনেসাঁসের ফলে হিন্দু সমাজ কী পেয়েছে?
উত্তর: চিন্তার স্বাধীনতা ও আধুনিক শিক্ষা।
৪০। লেখকের মতে বাংলার ঐক্য কীভাবে সম্ভব?
উত্তর: হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের মাধ্যমে।
৪১। লেখক কোন সমস্যাকে হিন্দু-মুসলমানের দুর্দশার কারণ বলেছেন?
উত্তর: সাম্প্রদায়িক সংঘাত
৪২। লেখক কোন দুটি জিনিসের মিলনের প্রত্যাশা করেছেন?
উত্তর: স্বাপ্নিক হিন্দু ও বাস্তুতান্ত্রিক মুসলমানের মধ্যে
৪৩। প্যান ইসলামি বোলচাল কথাটির অর্থ কী?
উত্তর: মৌলবাদী
৪৪। লেখকের মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন বিষয়ের গান গেয়েছেন?
উত্তর: মহামানবতার
৪৫। কাজী আবদুল ওদুদ কোন সাহিত্য সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন?
উত্তর: ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ
৪৬। বাংলার নবজাগরণের প্রভাত নক্ষত্র কে?
উত্তর: রাজা রামমোহন রায়
৪৭। ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৯২৬ সালে
৪৮। ‘বাংলার জাগরণ’ প্রবেন্ধের মূল উপজীব্য কী?
উত্তর: সমকালিন বাংলার সমাজ সংস্কৃতির বাস্তবচিত্র
৪৯। কার মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বাংলায় নবচিন্তা ও ভাবধারার সূচনা হয়েছে?
উত্তর: রাজা রামমোহন রায়ের
৫০। প্রবন্ধে কাকে মানবপ্রেমিক ও স্বদেশপ্রেমিক বলা হয়েছে?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দকে
৫১। ডিরোজিওর প্রভাবের গৌণ ফল কে?
উত্তর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত
৫২। অক্ষয়কুমার দত্ত কোন মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন?
উত্তর: কর্মবাদ
৫৩। অক্ষয়কুমার দত্তের সমীকরণ কোনটি?
উত্তর: প্রার্থনা + পরিশ্রম = শস্য, পরিশ্রম = শস্য, অতএব প্রার্থনা = ০
৫৪। রামকৃষ্ণ পরমহংস কোন শতকে বাংলায় আবির্ভূত হন?
উত্তর: উনিশ শতকে
৫৫। ধর্মীয় সত্য সম্পর্কে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বক্তব্য কী?
উত্তর: ‘যত মত তত পথ’
৫৬। ‘ভারত আধ্যাত্মিক, ইউরোপ জড়বাদী।’- উক্তিটি কার?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দের