‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের মূলভাব ও অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
‘প্রাগৈতিহাসিক’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্প। গল্পটি আবর্তিত হয় ভিখু নামে এক দস্যুকে কেন্দ্র করে। ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ যার একমাত্র জীবিকা। তাকে কখনও পুলিশও বেশিদিন জেলে বন্দি রাখতে পারেনি, দুই বছরের মাথায় প্রাচীর টপকিয়ে পালিয়েছে। তাই পুলিশের কাছে ভিখু মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল।
প্রাগৈতিহাসিক - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাগৈতিহাসিক গল্পের নায়ক ভিখু। সে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে বর্শার খোঁচা খেয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে পালিয়ে তার পরিচিত পেহ্লাদ বাগদীর বাড়ি আসে। পুলিশের ভয়ে পেহ্লাদ ভিখুকে নিজের বাড়ি আশ্রয় না দিয়ে বনে আশ্রয় দেয়। ভিখুর শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা, ঘা, জ্বালাপোড়া, পোকামাকড়ের উৎপাত, জোঁকের ঘা থেকে বিষরক্ত শোষণ, এসবের মধ্যে জীবনটাকে টিকিয়ে রাখে ভিখু। ভিখুকে পেহ্লাদ নিজের বাড়ি নিয়ে আসে তার বোনাই ভরতের সাহায্যে। ভিখু ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠে এবং একদিন পেহ্লাদের অবর্তমানে তার স্ত্রীর প্রতি আদিম লালসার প্রকাশ ঘটায়। এজন্য ভিখু প্রচণ্ড মার খেয়ে পেহ্লাদের ঘরছাড়া হয়। দীর্ঘদিনের অভুক্ত, দুর্বল ও ডানহাত অচল এককালের ডাকাত সর্দার ভিখু উপায়ন্তর না দেখে জীবিকার প্রয়োজনে বেছে নেয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন পেশা ভিক্ষা। এরপর ভিখু ক্রমশ ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে এসে জীবন কাটায়। কারণ একটা হাত নষ্ট হওয়ায় ডাকাতি করার শক্তি লুপ্ত হয়। ভিক্ষার পয়সায় তার সাময়িক দিন ফেরে, কিন্তু নারী সঙ্গহীন নিরুৎসব জীবন তার কাছে বিরক্তিকর। ভিখু ক্রমশ তার অস্থির জীবনযাপনের মধ্যে পরিচিত হয় বাজারের দগদগে ঘা নিয়ে ভিক্ষারত যুবতী পাঁচীর সঙ্গে। ভিখু পাঁচীর সাহচর্য আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু পাঁচী রাজি হয় না। পাঁচী এক সময় বসির মিয়ার সঙ্গিনী হয়। ভিখুর তা সহ্য হয় না। পাঁচীর সাহচর্য কামনা ক্রমশ তীব্র হয় ভিখুর। বসিরকে ভিখু এক গভীর রাতে সরু ধারালো লোহার শিক দিয়ে তারাভরা আকাশের নিচে অন্ধকারে বসির মিয়াকে নিষ্ঠুর ঈর্ষায় নির্মমভাবে হত্যা করে। পাশে শায়িত পাঁচী জেগে ওঠে। পাঁচীর সাহায্যে বসিরের ভিক্ষালব্ধ সঞ্চিত সমস্ত টাকা, জিনিসপত্র পুটলি বেঁধে পাঁচীকে সঙ্গে নিয়ে ভিখু বেরিয়ে পড়ে নতুন ভিক্ষাজীবন এবং সংসারজীবন গড়ার উদ্দেশ্যে। পাঁচীর পায়ে ঘা, হাঁটা কষ্ট, এর জন্য ভিখু তাকে কাঁধে নিয়ে চলে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে। এখানের গল্পের সমাপ্তি।
‘প্রাগৈতিহাসিক’ মূলত মানুষের জৈবিক ক্ষুধার ইতিহাস। জৈবিক ক্ষুধার জন্য মানুষ যে পশুতে পরিণত হতে পারে সে কথাই বর্ণিত হয়েছে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে। জৈব প্রেরণা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। ভিখু ও পাঁচী জন্মগতভাবে কামনা বাসনা ও জৈব তাড়না লাভ করেছে এবং এ প্রবৃত্তিকেই তারা আবার তাদের সন্তান সন্ততির মাঝে সঞ্চারিত করে যাবে। এ প্রবৃত্তি নিতান্তই প্রাগৈতিহাসিক।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’ মানবজীবনের সবচেয়ে আদিম এবং জৈবিক চাহিদার একটি গভীর অনুধ্যান। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভিখু একজন দস্যু, যার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আদিম মানবজাতির অস্তিত্বসংগ্রামের এক রূঢ় প্রতিচ্ছবি। তার জীবন চক্রে জৈবিক ক্ষুধা, লালসা এবং প্রাচীন প্রবৃত্তি গল্পের মর্মবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গল্পের শুরুতে আমরা পাই ভিখুকে, যিনি বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন। তার শরীরে বর্শার আঘাত নিয়ে পালানোর ঘটনাটি একটি প্রতীকী সূচনা। এখান থেকে শুরু হয় ভিখুর টিকে থাকার সংগ্রাম। পেহ্লাদ বাগদীর সহায়তায় সে বনজঙ্গলের মধ্যে কোনোমতে জীবন বাঁচায়। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার সাথে লড়াই করতে গিয়ে ভিখু যেন আদিম যুগের সেই মানবের প্রতীক হয়ে ওঠে, যার জীবন শুধু টিকে থাকার লড়াই।
পেহ্লাদের বাড়িতে সুস্থ হওয়ার পর ভিখুর চরিত্রের আরেকটি দিক উন্মোচিত হয়—তার আদিম কামনা। পেহ্লাদের স্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ তাকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে, যা তাকে ঘরছাড়া করে। এই অপমান এবং শারীরিক অক্ষমতা (ডানহাত অচল হওয়া) তাকে তার পুরনো জীবিকা, ডাকাতি, থেকে বিচ্যুত করে। ভিখু এবার বেছে নেয় ভিক্ষা, যা মানুষের আদিমতম পেশা বলে বিবেচিত।
গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভিখুর পাঁচীর সঙ্গে পরিচয়। বাজারের এক ভিখারিণী, যার শরীর জুড়ে দগদগে ঘা, পাঁচী একাধারে ভিখুর আকর্ষণের ও ঈর্ষার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ভিখু তার সাহচর্য কামনা করে, কিন্তু পাঁচী অন্য পুরুষ, বসির মিয়ার সঙ্গ গ্রহণ করে। এ ঘটনা ভিখুর মনের মধ্যকার ঈর্ষা এবং প্রতিশোধস্পৃহাকে জাগ্রত করে। ঈর্ষা ক্রমে তাকে হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। বসির মিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাঁচীকে নিয়ে ভিখু একটি নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে।
গল্পের শেষ দৃশ্য একধরনের প্রতীকী ধ্বনিতে পূর্ণ। পাঁচীর চলাফেরায় কষ্ট হওয়ায় ভিখু তাকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য একদিকে ভিখুর মানবিক চেহারা প্রকাশ করে, আবার অন্যদিকে তার নতুন ভিক্ষাজীবন এবং সংসার গঠনের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। কিন্তু এই সংসারও তাদের জৈবিক চাহিদার বাইরে কিছু নয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের মূলে রয়েছে মানুষের জৈবিক চাহিদার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব। ভিখু এবং পাঁচী জন্মগতভাবে যে প্রবৃত্তি বহন করে তা তাদের পরবর্তী প্রজন্মেও প্রবাহিত হবে। এই প্রবৃত্তি সভ্যতার সকল আড়ালকে ভেদ করে আদিম চেহারায় প্রকাশিত হয়।
গল্পটি উপস্থাপন করে যে, মানুষের জৈব প্রেরণা কতটা শক্তিশালী এবং এই প্রেরণা এক অর্থে প্রাগৈতিহাসিক, যা সভ্যতার আদিম যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষকে চালিত করে আসছে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প তাই শুধু একক কোনো চরিত্রের কাহিনি নয়; এটি মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির এক চিরন্তন প্রতিফলন।
অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর:
১। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে কোন শ্লোকটিকে অসত্য বলা হয়েছে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ’ শ্লোকটিকে অসত্য বলা হয়েছে
২। ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ’ শ্লোকটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ’ শ্লোকটির অর্থ ‘ভিক্ষার দ্বারা কখনো কিছু হয় না’।
৩। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে রাত্রে স্বরচিত বিছানায় কে ছটফট করে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে রাত্রে স্বরচিত বিছানায় ছটফট করে ভিখু
৪। ভিখুর কোন জীবন ভালো লাগে না?
উত্তর: নারীসঙ্গহীন নিরুৎসব জীবন ভিখুর ভালো লাগে না
৫। কোন জীবনটির জন্য ভিখুর মন হাহাকার করে?
উত্তর: অতীতের উদ্দাম ঘটনাবহুল জীবনটির জন্য ভিখুর মন হাহাকার করে
৬। ভিখু তাড়ি খেয়ে কার ঘরে গিয়ে উন্মত্ত রাত্রি যাপন করতো?
উত্তর: ভিখু তাড়ি খেয়ে বালীর ঘরে গিয়ে উন্মত্ত রাত্রি যাপন করতো
৭। কার পায়ে হাঁটুর নিচ হতে থকথকে তৈলাক্ত ঘা?
উত্তর: ভিখারিনি পাঁচীর পায়ে হাঁটুর নিচ হতে থকথকে তৈলাক্ত ঘা
৮। পাঁচী কীসের জোরে ভিখুর থেকে বেশি রোজগার করে?
উত্তর: পাঁচী তার পায়ের ঘায়ের জোরে ভিখুর থেকে বেশি রোজগার করে
৯। ‘ঘা টি সারবোনা, লয়?’- কে কাকে একথা বলে?
উত্তর: ভিখু পাঁচীকে বলে ‘ঘা টি সারবোনা, লয়?’
১০। কীসের উত্তাপে ভিখুর ঘৃণা উবে যায়?
উত্তর: প্রেমের উত্তাপে ভিখুর ঘৃণা উবে যায়
১১। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে জোয়ান দাড়িওয়ালা খঞ্জ ভিখারিটি কে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে জোয়ান দাড়িওয়ালা খঞ্জ ভিখারিটি বসির
১২। পাঁচীর সঙ্গীটির নাম কী?
উত্তর: পাঁচীর সঙ্গীটির নাম বসির
১৩। ‘লাঠির এক ঘায়ে শিরটি ছেঁচ্যা দিমু নে!’- কে কাকে একথা বলে ভয় দেখায়?
উত্তর: ‘লাঠির এক ঘায়ে শিরটি ছেঁচ্যা দিমু নে!’ খঞ্জ ভিখারি বসির ভিখুকে একথা বলে ভয় দেখায়
১৪। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের রচয়িতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ শব্দটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ শব্দটির অর্থ যে যুগ থেকে ইতিহাস জানা যায় তার পূর্বকালের
১৬। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নায়ক কে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নায়ক ভিখু
১৭। ভিখু সদলবলে কোথায় ডাকাতি করতে গিয়েছিলো?
উত্তর: ভিখু সদলবলে বসন্তপুরে ডাকাতি করতে গিয়েছিলো
১৮। ভিখু বর্শার খোঁচা খাওয়ার পর কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলো?
উত্তর: ১৮। ভিখু বর্শার খোঁচা খাওয়ার পর মাথাভাঙা পুলের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলো
১৯। ভিখু কত ক্রোশ পথ হেঁটে পেহ্লাদ বাগদীর বাড়িতে পৌছালো?
উত্তর: ভিখু নয় ক্রোশ পথ হেঁটে পেহ্লাদ বাগদীর বাড়িতে পৌছালো
২০। পেহ্লাদ বাগদীর বাড়ি কোথায়?
উত্তর: পেহ্লাদ বাগদীর বাড়ি চিতলপুরে
২১। বনে ভিখুকে খাবার জন্য পেহ্লাদ কী দিলো?
উত্তর: বনে ভিখুকে খাবার জন্য পেহ্লাদ চিড়া ও গুড় দিলো
২২। ভিখু কী কারণে নিজেই তার ঘায়ের চারদিকে জোঁক লাগিয়ে দিলো?
উত্তর: বিষাক্ত রক্ত শুষে নেওয়ার জন্য ভিখু নিজেই তার ঘায়ের চারদিকে জোঁক লাগিয়ে দিলো
২৩। ‘সে কিছুতেই মরিবে না’- কে মরবে না?
উত্তর: ভিখু
২৪। ‘বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে, বাঁচিবেই।’- কার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখুর কথা বলা হয়েছে
২৫। বৃষ্টির জলে ভিজে ভিখুর কী পচতে আরম্ভ করে?
উত্তর: পেহ্লাদের দেয়া চিড়াগুলো পচতে আরম্ভ করে
২৬। পেহ্লাদের বোনাই এর নাম কী?
উত্তর: পেহ্লাদের বোনাই এর নাম ভরত
২৭। ভিখু পেহ্লাদের বিরুদ্ধে কী চুরির অভিযোগ করে?
উত্তর: ভিখু পেহ্লাদের বিরুদ্ধে বাজু চুরির অভিযোগ করে
২৮। কে পেহ্লাদের ঘরে আগুন লাগায়?
উত্তর: ভিখু পেহ্লাদের ঘরে আগুন লাগায়
২৯। পেহ্লাদ কীসের ভয়ে ভিখুর নামটা পর্যন্ত মুখে নিতে পারলো না?
উত্তর: পেহ্লাদ পুলিশের টানাটানির ভয়ে ভিখুর নামটা পর্যন্ত মুখে নিতে পারলো না
৩০। কখন থেকে ভিখুর আদিম অসভ্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হলো?
উত্তর: পেহ্লাদের ঘরে আগুন লাগানোর রাত থেকে ভিখুর আদিম অসভ্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হলো
৩১। ভিখু কার কাছে প্রথম ভিক্ষার জন্য হাত পাতে?
উত্তর: ভিখু বাজারে রাস্তায় দেখা ভদ্রলোকটির কাছে প্রথম ভিক্ষার জন্য হাত পাতে
৩২। ‘দুটো পয়সা দিবান কর্তা’- উক্তিটি কার?
উত্তর: ‘দুটো পয়সা দিবান কর্তা’- উক্তিটি ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভিখুর
৩৩। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে কোনটিকে পৃথিবীর বহু পুরাতন ব্যবসা বলা হয়েছে?
উত্তর: ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে ভিক্ষাবৃত্তিকে পৃথিবীর বহু পুরাতন ব্যবসা বলা হয়েছে
৩৪। ভিখুর ভিক্ষাবৃত্তির সবচেয়ে জোরালো বিজ্ঞাপন কোনটি?
উত্তর: ভিখুর ভিক্ষাবৃত্তির সবচেয়ে জোরালো বিজ্ঞাপন তার শুকনো হাতখানা।