জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার বনলতা আসলে কে? বনলতার পরিচয়

বনলতা সেন: নিষিদ্ধ প্রেম ও বঞ্চিত নারীর মর্মন্তুদ আখ্যান

👉 'পাখির নীড়ের মত চোখ' আর 'বিদিশার নিশার মত' কালো চুল নিয়ে 'বনলতা সেন' কবিতার এই শুদ্ধতম নায়িকা রোমান্টিক বাঙালিদের মনোজগতে দেদীপ্যমান। জীবনানন্দ দাশ প্রেম, ঐতিহাসিকভাবে আগত সামাজিক সংকট ও প্রচলিত অর্থনীতিতে বঞ্চিত নারীর করুন প্রতিচ্ছবি চিত্রিত করেছেন সার্থক শিল্পীর মূল্যবোধের তুলিতে।

বনলতা সেন (প্রতীকী)


👉কবিতায় আমরা বনলতার অলোকসাধারণ রূপের বর্ণনা পাই, কিন্তু তার সামাজিক পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানিনা। সাহিত্য পিপাসুদের মনে সঙ্গতই প্রশ্ন জাগে, কে এই বনলতা সেন?

👉সাহিত্যের ইতিহাসে এই ধরনের সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। একই প্রশ্ন উঠেছে শেক্সপিয়রের সনেটের 'কৃষ্ণ রমনী'কে নিয়ে এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চির 'মোনালিসা'কে নিয়ে।

👉এই প্রশ্ন সমাধানের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিশিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান সৈয়দের লেখনিতে। তিনি লিখেছেন, "বরিশালে প্রথম যৌবনে হয়তো কোনো নারীর প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলেন জীবনানন্দ যার নাম ছিল 'বনলতা' (এটাই গোপন স্বভাবী কবির পক্ষে বেশি সম্ভব) অথবা কবি তার নামকরণ করেছিলেন 'বনলতা'। 'সেন' উপাধি দিয়ে 'নাটোর' নামক তদানীন্তন রাজশাহী জেলার একটি অঞ্চলের অধিবাসী করে তাকে বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট করেছিলেন।"

👉 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান লিখেছেন, "সরকারি চাকরিসূত্রে রাজশাহীতে অবস্থানকালে প্রশাসকদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও দলিল দস্তাবেজ হতে দেখা যায় যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে নাটোর শুধু কাঁচাগোল্লা ও জমিদারের জন্যই বিখ্যাত ছিলনা, নাটোর ছিল উত্তরবঙ্গের রূপাজীবাদের (পতিতাদের) সবচেয়ে বড় কেন্দ্র।"

👉উল্লেখিত কারণে আমাদের মনে হয় নাটোর বনলতা সেনের শুধুই ঠিকানা নয়, নাটোর শব্দটির দ্বারা তার পেশা সম্বন্ধে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে দেখলে বনলতা সেন নামটির তাৎপর্য সহজে বোঝা যায়। 'সেন' পদবী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সে ভদ্র বংশোদ্ভূত। বনলতা বাংলাদেশে ব্যবহৃত কোনো সাধারণ নাম নয়। তার স্খলনের জন্য বা তার নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য সে হয়তো ছদ্মনাম নিয়েছে।

👉বনলতার এই পরিচয় কবিতাটিকে একটি সম্পূর্ণ নতুন দ্যোতনা দেয়। এখন আমরা বুঝতে পারি বনলতা সেন কেন কবিকে 'দু দণ্ড শান্তি' দিয়েছিল। বুঝতে পারি কেন কবির অভিসার 'নিশীথের অন্ধকারে' এবং 'দূর অন্ধকারে'।

নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন

👉এই পটভূমিতে 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন নয়, বনলতা সেন যেন বলতে চাচ্ছে যে সে ইচ্ছা করে রূপাজীবার বৃত্তি গ্রহণ করেনি, তার জীবনে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে। সেই দুঃসময়ে তার পাশে কেউ ছিলনা। 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' - একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন নয়, এ হচ্ছে বিপর্যস্ত নারীর আর্তনাদ। বনলতার পরিচয় পেলেই আমরা বুঝতে পারি কবি কেন কবিতার শেষে বলেছেন 'সব পাখি ঘরে ফেরে'।

👉বনলতাদের সাথে দুদণ্ড সময় কাটালেও শেষ পর্যন্ত বিবাহিত পুরুষদের লাবণ্যপ্রভাদের (স্ত্রীদের) নিকট ফিরে আসতে হয় কিংবা ভদ্র সমাজের যুবাদের ঘরে ফিরে আসতে হয়।

👉বনলতাকে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে প্রকাশ্যে পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বনলতার কথা কাউকে বলারও উপায় নেই। বনলতাকে নিরবে নিভৃতে স্মরণ করতে হয় অপরাধবোধ নিয়ে। তাই কবি বলেছেন, 'থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।' এই অন্ধকার প্রাকৃতিক নয়, এই অন্ধকার মানসিক। এভাবেই নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ বেদনা ও বঞ্চিত নারীর প্রতিচ্ছবি কবি 'বনলতা সেন' কবিতায় সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url