কিছু সিমিলার ইতিহাস
১. নিকোলাস চাউশেস্কু, রোমানিয়া (১৯৮৯)
রোমানিয়ার কমিউনিস্ট নেতা নিকোলাস চাউশেস্কু ১৯৬৫ সালে ক্ষমতা দখল করেন এবং একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কঠোরভাবে বিরোধীদের দমন করেন এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের জনগণকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলেন। ১৯৮৯ সালে বুখারেস্টে একটি জনসমাবেশে জনগণের বিদ্রোহে তার শাসন ভেঙে পড়ে। জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং চাউশেস্কু ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করে সামরিক আদালতের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ক্ষমতার লড়াই |
২. সাদ্দাম হোসেন, ইরাক (২০০3)
সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট হন এবং অত্যাচারী শাসন চালান। তিনি সামরিক শক্তি ব্যবহার করে তার ক্ষমতা ধরে রাখেন। তবে তার শাসন দেশের ভেতরে এবং বাইরে সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আক্রমণের মাধ্যমে তার শাসনের অবসান ঘটে। ইরাকের জনগণ তার পতনকে স্বাগত জানায় এবং তিনি পরবর্তীতে গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন।
৩. মুয়াম্মার গাদ্দাফি, লিবিয়া (২০১১)
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ১৯৬৯ সালে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন এবং চার দশক ধরে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউয়ে লিবিয়ার জনগণ বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের সময় তাকে হত্যা করা হয়, এবং তার শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন
৪. হোসনি মুবারক, মিসর (২০১১)
মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে একনায়কতন্ত্র চালান। তার শাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ও দমননীতি প্রচলিত ছিল। ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় মিসরের জনগণ তার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আন্দোলনের চাপে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৫. আদমিরাল ডুইট বাল্টাজার, আর্জেন্টিনা (১৯৮৩)
আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তা ১৯৭৬ সালে ক্ষমতা দখল করে এবং কঠোর দমননীতি চালায়। তাদের শাসনে "ডার্টি ওয়ার" (Dirty War) নামে পরিচিত এক দমনমূলক অভিযান পরিচালিত হয়, যার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের পর জনগণ সামরিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে, এবং ১৯৮৩ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. ইদিয় আমিন, উগান্ডা (১৯৭৯)
ইদিয় আমিন ১৯৭১ সালে উগান্ডার ক্ষমতা দখল করেন এবং নিষ্ঠুর একনায়কতন্ত্র চালান। তার শাসনে গণহত্যা, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। ১৯৭৯ সালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-অসন্তোষ ও সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
৭. জাঁ-বেদেল বোকাসা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (১৯৭৯)
জাঁ-বেদেল বোকাসা ১৯৬৬ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৭৬ সালে নিজেকে সেন্ট্রাল আফ্রিকান সাম্রাজ্যের সম্রাট ঘোষণা করেন। তার শাসনকাল ছিল অত্যাচার, দুর্নীতি এবং অপচয়ের জন্য berবরচিত। ১৯৭৯ সালে একটি ফ্রান্স-সমর্থিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, এবং জনগণ তার শাসনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।
৮. ফার্দিনান্দ মার্কোস, ফিলিপাইন (১৯৮৬)
ফার্দিনান্দ মার্কোস ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হন এবং পরে সামরিক আইন জারি করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা চরমে পৌঁছায়। ১৯৮৬ সালে "পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন"-এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
৯. অগাস্টো পিনোশে, চিলি (১৯৯০)
অগাস্টো পিনোশে ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিলির ক্ষমতা দখল করেন। তার শাসনকাল ছিল ভয়াবহ দমননীতি, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ বা নিহত হয়। ১৯৮৮ সালের গণভোটে জনগণ তার শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং ১৯৯০ সালে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন।
১০. চার্লস টেইলর, লাইবেরিয়া (২০০৩)
চার্লস টেইলর ১৯৯৭ সালে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে তার শাসন দুর্নীতি, গৃহযুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভরা ছিল। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠে। ২০০৩ সালে ব্যাপক জনঅসন্তোষ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করে নির্বাসনে যান।
১১. হিটলার, জার্মানি (১৯৪৫)
আডলফ হিটলার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসেন, তবে পরবর্তীতে জোরপূর্বক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার আক্রমণাত্মক নীতি ও নাৎসি শাসনের কারণে জনগণ ব্যাপক দুর্ভোগে পড়ে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তার শাসনের অবসান ঘটে। জার্মান জনগণ তার শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
১২. নিকোলাস মাদুরো, ভেনেজুয়েলা (বিতর্কিত)
যদিও নিকোলাস মাদুরো এখনো ক্ষমতায় আছেন, তার শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের বড় অংশ বিক্ষোভ করেছে। ২০১8 সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার পর দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট, দুর্ভিক্ষ এবং গণবিক্ষোভ শুরু হয়। অনেক দেশ তার শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
১৩. রবার্ট মুগাবে, জিম্বাবুয়ে (২০১৭)
রবার্ট মুগাবে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন, তবে পরবর্তীতে তিনি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার দীর্ঘ শাসন দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য সমালোচিত হয়। ২০১৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ও জনগণের চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৪. পল পোত, কম্বোডিয়া (১৯৭৯)
পল পোত ও তার খেমার রুজ শাসন ১৯৭৫ সালে কম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করে। তার শাসন ছিল গণহত্যার জন্য berবরচিত, যেখানে প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সামরিক হস্তক্ষেপে তার শাসনের অবসান ঘটে, এবং জনগণ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে।
১৫. সুহার্তো, ইন্দোনেশিয়া (১৯৯৮)
সুহার্তো ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পরিচিত ছিল। ১৯৯৮ সালে এশীয় অর্থনৈতিক সংকট এবং গণবিক্ষোভের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
পর্যবেক্ষণ:
উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে দেখা যায়, জনগণের সমর্থন ছাড়া এবং জোরপূর্বক ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে এমন শাসনের পরিণতি সাধারণত পতন ও ঘৃণায় পর্যবসিত হয়। এই উদাহরণগুলো দেখায় যে জনগণের সমর্থন ছাড়া শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। একনায়কতন্ত্র বা জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল সাময়িকভাবে সফল হলেও তা শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রত্যাখ্যানের মুখে পতিত হয়।