‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের মূলভাব এবং অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর
যে কয়জন কথাসাহিত্যিক বাংলা কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক অগ্রগণ্য। তার গল্পে গ্রামবাংলার শোষিত জীবনসংগ্রাম ও হতাশা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে প্রাধান্য পায় দেশভাগের যন্ত্রণাময় ফলস্বরূপ অধঃপতিত সমাজের সুস্পষ্ট রূপ, যেখানে অর্থের বিনিময়ে নিজের যুবতী মেয়েকে যুবকদের হাতে সঁপে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বৃদ্ধের জীবনের চরম লজ্জা উন্মোচিত হয়েছে।
আত্মজা ও একটি করবী গাছ |
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পে একটি জাতির ভাঙনের ইতিহাস ও তার বেদনাবহ পরিণতিকে লেখক অসাধারণ দক্ষতায় মূর্ত করে উপস্থাপন করেন। এ গল্পের কেশো বুড়ো বিপন্ন লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত মানুষের প্রতীক আর করবী গাছ হচ্ছে তার আত্মজার প্রতীক। আত্মজাও তার কাছে বিষবৃক্ষের বীজ, তার ভিতর বাইরে মরণঘাতী নিষাদ। গল্পটির সূচনায় অসংলগ্ন ও বিক্ষিপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে অতি সামান্য পরিসরেও লেখক প্রতিটি চরিত্রকে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব প্রদানে সক্ষম হন। ফলে দেখা যায় যে, তিনটি যুবক নৈশ অভিসারে সহযাত্রী, তাদের মধ্যে গোপন বৈরিতা রয়েছে, রয়েছে এক ধরনের উদ্বেগ, এমনকি রয়েছে অপরাধবোধও। বৃদ্ধ ও তার পরিবারের নিরুপায় অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে তারা, এমন কথাও তাদের আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়। গল্পের শুরুতে ডাকু শিয়ালের মুখে মুরগির চিত্রকল্পে শিয়ালটি হচ্ছে পকেটমার ফেকু, নাপিত সুহাস ও বেকার ইনামের প্রতীক চরিত্র। আর ওদের শিকার উদ্বাস্তু পিতার কিশোরী কন্যা রুকু হচ্ছে ডানা ঝাপটানো অসহায় মুরগির প্রতীক। তিন বখাটের নৈশ অভিসারের বৃত্তান্তের সূত্রে লেখক সমসাময়িক অস্থির-বিশৃঙ্খল সময়কে উপস্থাপন করেন। ওদের কথাবার্তা আপাত খাপছাড়া কিন্তু গল্পকার প্রত্যেকটি কাটা কাটা বাক্য ও শব্দের ব্যবহার করেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ওরা জানালার রড ধরে দাঁড়াতেই বেরিয়ে আসেন এক পিতা। সৌজন্য, সম্ভ্রম সব রক্ষা করেই একটি রফা হয়। মেয়েকে বখাটেদের হাতে তুলে দিয়েই শুরু হয় এ পিতার নিষ্ঠুর অভিনয়। পৃথিবীর কাছে পরাস্ত হলেও নিজের কাছে অজেয় থাকার দৃঢ়প্রত্যয়ী পিতা নৈতিকতার কৃত্রিম অহংকার বা আবরণ তৈরি করে মিথ্যার মোড়কে। পাশের ঘরে ফেকু-সুহাস মেয়ের শরীর নিয়ে তৈরি করে নতুন গল্প। সেই গল্পের মরণ চিৎকার ও উল্লাসের ফাঁকে আর একটি গল্পের ফাঁদ পাতেন মেয়ের পিতা- একটি করবী গাছের গল্প। করবী বিচির উল্লেখে আত্মহননের একটি ইঙ্গিত আছে। এটি এ বৃদ্ধের জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের চূড়ান্ত স্বীকারোক্তি, সমাজকে ছুঁড়ে দেওয়া তার শেষ তিরস্কার।
এ গল্প ব্যক্তিবিশেষ বা পরিবার বিশেষের হলেও দেশভাগের ফাঁদে পড়া সকল উদ্বাস্তু মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে গল্পের পাত্রপাত্রীরা। এটি শুধু একটি করবী গাছের গল্প নয়, অসংখ্য উদ্বাস্তু প্রাঙ্গণের করবী গাছের গল্প। এ করবী গাছের বিষাক্ত বিষ সেই বৃদ্ধ নিজের জন্য নয়, তার আত্মজার জন্য চাষ করেছে, অপেক্ষায় আছে পূর্ণ স্ফোটনের। এ বিষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিদ্বেষ ও দাঙ্গা সৃষ্টি করে; নিঃস্ব ও নৈতিকতা বিবর্জিত করে দেহে, মনে ও মননে।
হাসান আজিজুল হক রচিত ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ একটি শক্তিশালী গল্প, যা দেশভাগ-পরবর্তী সমাজের ভাঙন, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অসহায় মানুষের দুঃসহ জীবন সংগ্রামকে গভীরভাবে প্রতিফলিত করে। এই গল্পে এক পিতার করুণ পরিস্থিতি, আত্মসম্মান বোধ ও জীবনের চরম বাস্তবতার সংঘাতের মধ্য দিয়ে দেশভাগের প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র কেশো বুড়ো একজন উদ্বাস্তু, যে তার কন্যাকে যুবকদের হাতে তুলে দিয়ে নিজের জীবনের চরম লজ্জা ও পরাজয়ের সাক্ষী হয়। কন্যা রুকু কেবল তার মেয়ে নয়, বরং এক বিপন্ন ভবিষ্যতের প্রতীক, যা তার পিতার জন্য বিষবৃক্ষের মতো। করবী গাছটি এখানে প্রতীকী; এটি যেমন বিষাক্ত, তেমনই আত্মজার ভবিষ্যৎও তার জন্য মৃত্যুর ইঙ্গিতবাহী।
গল্পে তিন যুবকের চরিত্র—পকেটমার ফেকু, নাপিত সুহাস ও বেকার ইনাম—সমাজের ভ্রষ্টাচার ও স্বার্থপরতার প্রতিনিধিত্ব করে। তারা কেশো বুড়োর অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয়। তাদের আচরণে, কথোপকথনে ও তাদের মধ্যে থাকা গোপন বৈরিতা, অপরাধবোধ, এবং উদ্বেগ সমাজের বিশৃঙ্খল সময়কে তুলে ধরে। গল্পের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি বাক্যে, প্রতীক এবং চরিত্রে লেখক সময়ের যন্ত্রণা ও মানুষের মানবিক অবক্ষয়ের গভীর চিত্র এঁকেছেন।
গল্পের ক্লাইম্যাক্সে মেয়েকে তুলে দিয়ে পিতা করবী গাছের গল্প বলেন, যা কেবল আত্মহননের ইঙ্গিত নয়, বরং তার জীবনের প্রতি সমাজের অবজ্ঞা এবং অবহেলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। করবী গাছের বিষ এখানে সাম্প্রদায়িক বিভেদ, দাঙ্গা, এবং মানুষের নৈতিকতার ধ্বংসের প্রতীক।
এই গল্প শুধু কেশো বুড়োর নয়, এটি দেশভাগের ফলে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লক্ষ মানুষের গল্প। তাদের জীবনে করবী গাছের মতো বিষের বীজ রোপিত হয়েছে, যা তাদের অস্তিত্বকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। হাসান আজিজুল হকের এই গল্প মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং দেশভাগের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক পরিণতির তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে দাঁড়ায়।
নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর:
১. ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের রচয়িতা কে?
উত্তর: হাসান আজিজুল হক।
২. গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম কী
উত্তর: কেশো বুড়ো।
৩. গল্পটি কোন সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত?
উত্তর: দেশভাগ-পরবর্তী সময়।
৪. কেশো বুড়ো কাকে প্রতীকায়িত করে?
উত্তর: উদ্বাস্তু ও লাঞ্ছিত মানুষের।
৫. করবী গাছ কী প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর: বিষাক্ত ভবিষ্যতের প্রতীক।
৬. গল্পের পিতা কী সিদ্ধান্ত নেন?
উত্তর: মেয়েকে যুবকদের হাতে তুলে দেন।
৭. রুকু চরিত্রটি কিসের প্রতীক?
উত্তর: অসহায় ভবিষ্যতের।
৮. গল্পে কোন তিন যুবকের কথা উল্লেখ আছে?
উত্তর: ফেকু, সুহাস ও ইনাম।
৯. তিন যুবক কী প্রকাশ করে?
উত্তর: সমাজের ভ্রষ্টাচার ও স্বার্থপরতা।
১০. গল্পে মেয়েকে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে পিতা কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: নিজের জীবনের চরম পরাজয়।
১১. পিতা করবী গাছের গল্প কেন বলেন?
উত্তর: আত্মহননের ইঙ্গিত দিতে।
১২. গল্পে করবী গাছের বিষ কী বোঝায়?
উত্তর: সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও দাঙ্গা।
১৩. গল্পে বখাটেদের আচরণ কেমন ছিল?
উত্তর: স্বার্থপর ও শোষণমূলক।
১৪. গল্পে পিতার চরিত্র কী নির্দেশ করে?
উত্তর: নৈতিকতার দ্বন্দ্ব ও পরাজয়।
১৫. গল্পের সূচনায় কী চিত্রকল্প ব্যবহার করা হয়েছে?
উত্তর: ডাকু শিয়ালের মুখে মুরগির।
১৬. শিয়াল কাদের প্রতীক?
উত্তর: ফেকু, সুহাস ও ইনামের।
১৭. মুরগির চিত্রকল্প কার প্রতীক?
উত্তর: রুকুর।
১৮. তিন যুবকের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল?
উত্তর: গোপন বৈরিতা ও অপরাধবোধ।
১৯. গল্পে মেয়ের পিতার মনোভাব কেমন ছিল?
উত্তর: নিষ্ঠুর বাস্তবতায় ভেঙে পড়া।
২০. করবী গাছের বিষ বৃদ্ধ কিসের জন্য চাষ করেছেন?
উত্তর: তার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য।
২১. গল্পে যুবকদের কথোপকথনের ধরন কী?
উত্তর: আপাত খাপছাড়া।
২২. গল্পে দেশভাগ কীভাবে প্রভাব ফেলে?
উত্তর: মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মাধ্যমে।
২৩. গল্পে করবী গাছ কী ইঙ্গিত দেয়?
উত্তর: আত্মহননের ও চূড়ান্ত ক্ষোভের।
২৪. গল্পের প্রেক্ষাপট কী?
উত্তর: দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের জীবনের সংগ্রাম।
২৫. গল্পে পিতার আত্মসম্মান কিসের দ্বারা প্রভাবিত হয়?
উত্তর: দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের দ্বারা।
২৬. তিন যুবকের অপরাধবোধের কারণ কী?
উত্তর: কেশো বুড়োর অসহায় অবস্থার সুযোগ নেওয়া।
২৭. গল্পের মূল সংকট কী?
উত্তর: সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয়।
২৮. গল্পে মেয়েকে তুলে দেওয়ার রফা কী বোঝায়?
উত্তর: মানবিকতার চরম পরাজয়।
২৯. গল্পের বার্তা কী?
উত্তর: দেশভাগের ভয়াবহতা ও তার প্রভাব।
৩০. কেশো বুড়ো কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন?
উত্তর: সমাজের অবজ্ঞা ও অবহেলার।
৩১. গল্পের প্রতীকী বার্তা কী?
উত্তর: সমাজের ভাঙন ও বিষাক্ত ভবিষ্যৎ।
৩২. গল্পে যুবকরা কীভাবে নিজেরা ভিন্ন?
উত্তর: বৈরিতা ও লোভ দ্বারা।
৩৩. গল্পটি কাদের প্রতিনিধিত্ব করে?
উত্তর: দেশভাগে নিঃস্ব হওয়া সকল উদ্বাস্তুদের।
৩৪. করবী গাছের বিষ বৃদ্ধ নিজে কেন ব্যবহার করেন না?
উত্তর: আত্মজার ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেন।
৩৫. গল্পের সমাপ্তিতে করবী গাছ কী প্রকাশ করে?
উত্তর: চূড়ান্ত হতাশা ও প্রতিবাদ।
৩৬. গল্পের ভাষা কেমন?
উত্তর: প্রতীকী ও সংক্ষিপ্ত।
৩৭. গল্পে সমাজের অবস্থা কীভাবে ফুটে উঠেছে?
উত্তর: ভ্রষ্টাচার ও অস্থিরতার মাধ্যমে।
৩৮. গল্পে দেশভাগের কী প্রভাব দেখা যায়?
উত্তর: পরিবার ও সমাজের ভাঙন।
৩৯. গল্পের মাধ্যমে লেখক কী শোক প্রকাশ করেছেন?
উত্তর: দেশভাগে মানুষের অসহায়ত্ব ও ক্ষতি।
৪০. গল্পটি পাঠকের মনে কী সৃষ্টি করে?
উত্তর: তীব্র বেদনা ও সচেতনতার আহ্বান।
৪১। গল্পটি কী জাতীয় ছোটগল্প?
উত্তর: প্রতীকী ছোটগল্প
৪২। আত্মজা শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: কন্যা, দুহিতা, মেয়ে
৪৩। গল্পে কোন ঋতুর বর্ণনা আছে?
উত্তর: শীত ঋতু
৪৪। গল্পে কার বাড়ির টিনের চাল হিম ঝকঝক করে?
উত্তর: রাহাত খানের
৪৫। গল্পে হিম আর চাঁদ কোথায় ফুটে আছে?
উত্তর: নারকেল গাছের মাথায়
৪৬। ‘ইস্কুল যাতিছিস না আজকাল?’- কে কাকে জিজ্ঞেস করে?
উত্তর: সুহাস জিজ্ঞেস করে ইনামকে
৪৭। ‘হয়, চাকরি গাছে ফলিতেছে’- উক্তিটির অর্থ কী?
উত্তর: চাকরি সহজলভ্য নয়
৪৮। রাস্তায় যেতে যেতে ইনামের কী কথা মনে পড়ে?
উত্তর: বিকেলের কথা, হাটবারের কথা, নদী, স্কুল ও মাস্টারদের কথা
৪৯। ‘শালার জোকার একডা’ কার সম্পর্কে ইনামের এরূপ ধারণা?
উত্তর: স্কুলের হেডমাস্টার
৫০। ‘ইস্কুলি লেহাপড়া বিয়োচ্ছে’- কে উক্তিটি হয়েছে?
উত্তর: ইনাম
৫১। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই, সব এক হয়ে গেছে- উক্তিটি কার?
উত্তর: কেশো বুড়োর
৫২। আমি প্রথম একটা করবী গাছ লাগাই- এখানে কে করবী গাছ লাগায়?
উত্তর: কেশো বুড়ো
৫৩। করবী ফুলের বিচি থেকে কী পাওয়া যায়?
উত্তর: চমৎকার বিষ