‘হুযুর কেবলা’ গল্পের মূলভাব ও অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যঙ্গস্রষ্টা, গল্পকার, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ। তার ‘হুযুর কেবলা’ একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। এ গল্পে ধর্মের নামে ভন্ডামির এক অসাধারণ চিত্র নিপুণতা ও রঙ্গব্যঙ্গের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে। এখানে দেখা যায়, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, ক্ষমতার আধিপত্য এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে স্বার্থ হাসিল মানবিক জীবনসত্যকে কীভাবে বিড়ম্বিত করে। এ গল্পের ভণ্ড পীর ‘হুযুর কেবলা’ , ধর্মের নামে যত তার ছলাকলা।

 

হুযুর কেবলা - আবুল মনসুর আহমদ
হুযুর কেবলা - আবুল মনসুর আহমদ 

ঊনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে এদেশে প্রবলভাবে জেঁকে বসেছিলো পীরপ্রথা। সমাজে ব্যাপকভাবে চলতো পীরতোষণ। অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার আর কূপতমণ্ডুকতার সুযোগে ভণ্ডপীরেরা খুব সহজেই সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতো। সমাজে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা পীর ব্যবসার শিল্পিত আলেখ্য ‘হুযুর কেবলা’ ছোটগল্প। এ গল্পেও ভণ্ডপীর অবলীলায় বানানো কথা বলেন, নিজের কেরামতি দেখানোর জন্য নানা ছলনার আশ্রয় নেন। ফারসি, উর্দু, আরবি, বাংলার মিশেলে একধরনের অদ্ভুত অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন। তার মুখে থাকে সর্বদা ধর্মকথা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার বাসনা। হুযুর কেবলা খুবই চতুর এবং অভিনয় নিপুণ। মুরিদদের বিভ্রান্ত করার জন্য ‍হুযুর কেবলা অবলীলায় মিথ্যা কথা বলেন। হুযুর কেবলা কামুক এবং নারীলোলুপ। তাই নারীমহলে বয়ান করতে তিনি বেশি সময় দিতেন। গায়ে পোশাকে সুগন্ধি মেখে যেতেন। ভণ্ডপীরের এসব আচরণের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতাপ ও পরাক্রমে বিদ্রোহ করেছে এমদাদ। সে সূক্ষ্মদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে পীরের আচার আচরণ। পীর সাহেবের ভাত ভাঙার কসরত, অন্দরমহলের নারীদের ধর্মকথা শোনানোর কৌশল, বাড়িওয়ালর ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমনের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত, ফানাফিল্লিার সময় ‘জ্বলিয়া গেলাম পুড়িয়ে গেলাম’ চিৎকার, সুফী বদরুদ্দিনের সঙ্গে মাঝেমধ্যে পীরের একান্ত কানাকানির ঘটনা দেখে এমদাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। মুরিদদের পৌনঃপুনিক অনুরোধে পীর সাহেব একসময় তার কেরামতি দেখাতে রাজি হন। রুহের বিধান অনুসারে ভণ্ডপীর বিয়ে করেন রজবের স্ত্রী কলিমনকে। বদরুদ্দিন আর পীরের এসব কর্মকাণ্ড সহ্য করতে না পেরে একসময় এমদাদ আক্রমণ করে বসে পীর সাহেবকে। একলাফে বরাসনে উপবিষ্ট পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তার মেহেদি রঞ্জিত দাড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বলে, ‘রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপবাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিলো না?’ পীরের মুরিদেরা শেষ পর্যন্ত এমদাদকে নিবৃত্ত করে এবং মাতব্বরের নির্দেশে গ্রাম থেকে বের করে দেয়।

আবুল মনসুর আহমদ রাজনীতি ও সমাজসচেতন লেখক। রঙ্গব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি সমাজের নানামাত্রিক গলদ, অসংগতি ও ভণ্ডামি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যেসব অপপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি লেখনী চালনা করেছেন, সেসব অপপ্রথা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেড়েছে বলেই মনে হয়। সে সূত্রে আবুল মনসুর আহমদ ‘হুযুর কেবলা’ এখনো আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

‘হুযুর কেবলা’ আবুল মনসুর আহমদের একটি সমাজসচেতন ব্যঙ্গাত্মক রচনা, যা ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভণ্ডামি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করে। গল্পটির মূলভাব হলো ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পীরপ্রথার নামে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, প্রতারণা, এবং ব্যক্তিস্বার্থের পূর্ণতার নোংরা চিত্র তুলে ধরা।

গল্পে ভণ্ডপীর হুযুর কেবলার চরিত্রটি ধর্মের নামে ছলচাতুরীর প্রতীক। তিনি ধর্মীয় আচার ও কেরামতির নামে সাধারণ মানুষের সরলতা ও অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে নিজের লালসা এবং স্বার্থসিদ্ধি করেন। মুরিদদের বিভ্রান্ত করতে হুযুর কেবলা ধোঁকাবাজি, কল্পিত কেরামতি এবং নারীলোলুপতার আশ্রয় নেন। তার এসব আচরণের বিরুদ্ধে চরিত্র এমদাদের প্রতিবাদ দেখায় যে, সমাজের অন্যায় ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সচেতন মানুষের অবস্থান কী হওয়া উচিত।

এ গল্পের মাধ্যমে লেখক সমাজের গভীর সংকট এবং অনৈতিকতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিশেষ করে, ধর্মের আড়ালে যে শোষণ, প্রতারণা ও অবিচার চলতে পারে, তা পাঠকদের চিন্তাশীল করে তোলে। এই গল্প এখনো সমকালীন সমাজে প্রাসঙ্গিক, কারণ ধর্মীয় ভণ্ডামি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং লোভ আজও সমাজের এক বড় চ্যালেঞ্জ।

হুযুর কেবলা কেবল একটি গল্প নয়, এটি সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যা ধর্মকে মানুষের কল্যাণের পথে ব্যবহার করার আহ্বান জানায় এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে শেখায়।

 

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর:

১। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে কাদের ধর্মকথা বুঝাতে একটু দেরি হতো?

উত্তর: স্ত্রীলোকদের ধর্মকথা বুঝাতে একটু দেরি হতো

২। কার সম্বন্ধে পীর সাহেবের ধারণা অন্যরকম ছিলো?

উত্তর: বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমন সম্বন্ধে পীর সাহেবের ধারণা অন্যরকম ছিলো

৩। মেয়েদের মজলিসে ওয়াজ করার সময় পীর সাহেব কার দিকে ঘনঘন দৃষ্টিপাত করতেন?

উত্তর: মেয়েদের মজলিসে ওয়াজ করার সময় পীর সাহেব বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমনের দিকে ঘনঘন দৃষ্টিপাত করতেন

৪। পীর সাহেবের মতে তাসাউয়াফের বাতেনি কথা বুঝার কিছু ক্ষমতা কার মধ্যে আছে?

উত্তর: পীর সাহেবের মতে রজবের স্ত্রী কলিমনের মধ্যে তাসাউয়াফের বাতেনি কথা বুঝার কিছু ক্ষমতা আছে।

৫। পীর সাহেবের জজবা কখন একটু বেশি হতো?

উত্তর: মেয়েদের সামনে ওয়াজ করার সময় পীর সাহেবের জজবা একটু বেশি হতো

৬। হুযুর কেবলার প্রধান খলিফার নাম কী?

উত্তর: হুযুর কেবলার প্রধান খলিফার নাম সুফি বদরুদ্দিন

৭। কলিমন কে?

উত্তর: কলিমন রজবের স্ত্রী

৮। রজব কত বছর আগে কলিমনকে বিয়ে করেছিলো?

উত্তর: রজব এক বছর আগে কলিমনকে বিয়ে করেছিলো

৯। এমদাদ পীর সাহেবের কী ধরে টান মারে?

উত্তর: এমদাদ পীর সাহেবের মেহেদি রঞ্জিত দাড়ি ধরে টান মারে

১০। এমদাদ পীর সাহেবকে কী বলে গালি দেয়?

উত্তর: এমদাদ পীর সাহেবকে ভণ্ড শয়তান বলে গালি দেয়

১১। এমদাদকে কারা চড়চাপড় মারতে থাকে?

উত্তর: পীর সাহেবের শাগরেদ মুরিদরা এমদাদকে চড়চাপড় মারতে থাকে

১২। এমদাদের কী সম্বন্ধে পীর সাহেবের মুরিদেরা নিঃসন্দেহ হয়?

উত্তর: এমদাদের মস্তিষ্ক বিকৃতি সম্বন্ধে পীর সাহেবের মুরিদেরা নিঃসন্দেহ হয়

১৩। মাতব্বর সাহেব এমদাদের ব্যাপরে কী হুকুম করেন?

উত্তর: মাতব্বর সাহেব এমদাদকে কানে ধরে গ্রাম থেকে বের করে দিতে হুকুম করেন

১৪। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের রচয়িতা কে?

উত্তর: ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের রচয়িতা আবুল মনসুর আহমদ

১৫। ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থটি কত সালে প্রকাশিত হয়?

উত্তর: ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থটি  প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে

১৬। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের প্রধান চরিত্র কে?

উত্তর: ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের প্রধান চরিত্র এমদাদ

১৭। এমদাদ বিলাসী জীবন ত্যাগ করে কীসে যোগদান করে?

উত্তর: এমদাদ বিলাসী জীবন ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে

১৮। রাস্তায় বহু লোকের সালাম পেয়ে এমদাদের কী মনে হয়?

উত্তর: রাস্তায় বহু লোকের সালাম পেয়ে এমদাদের মনে হয় কলিযুগেও দুনিয়ায় ধর্ম আছে

১৯। এমদাদ কোন বিষয়ে অনার্স পড়ছিলো?

উত্তর: এমদাদ দর্শনে অনার্স পড়ছিলো।

২০। এমদাদ কলেজ ম্যাগাজিনে অনেকবার কী প্রমাণ করেছিলো?

উত্তর: এমদাদ কলেজ ম্যাগাজিনে অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করেছিলো

২১। খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করার জন্য এমদাদ কাদের ভাব চুরি করতো?

উত্তর: খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করার জন্য এমদাদ মিল, হিউম, স্পেন্সার, কোমটের ভাব চুরি করতো

২২। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে কোন ঘটনায় এমদাদ একেবারে বদলে যায়?

উত্তর: ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে এমদাদ একেবারে বদলে যায়

২৩। বহু চেষ্টা করেও এমদাদ কীসে নিষ্ঠা আনতে পারছিলো না?

উত্তর: বহু চেষ্টা করেও এমদাদ ইবাদতে নিষ্ঠা আনতে পারছিলো না

২৪। এমদাদ কাকে বহু শাসায়?

উত্তর: এমদাদ নিজেকে বহু শাসায়

২৫। ‘পোড়া ঘুম’ এমদাদকে কী বাধ্য করতে লাগে?

উত্তর:  ‘পোড়া ঘুম’ এমদাদকে তাহাজ্জুদের নামাজ তরক করতে বাধ্য করতে লাগে

২৬। ‘জজবা’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তর:  ‘জজবা’ শব্দের অর্থ দিব্য ভাবোন্মত্ততা বা ঐশী আবেগ

২৭। ‘সুলক’ শব্দের অর্থ কী?

উত্তর: ‘সুলক’ শব্দের অর্থ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন

২৮। এমদাদের সংসারের একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক কে?

উত্তর: এমদাদের সংসারের একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক তার বৃদ্ধা ফুফু

২৯। এমদাদ কাকে কাঁদিয়ে পীর জিয়ারতে বের হয়?

উত্তর: এমদাদ তার সংসারের একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক বৃদ্ধা ফুফুকে কাঁদিয়ে পীর জিয়ারতে বের হয়

৩০। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে মেহেদি রঞ্জিত দাড়িবিশিষ্ট বৃদ্ধ লোকটি কে?

উত্তর: ‘হুযুর কেবলা’ গল্পে মেহেদি রঞ্জিত দাড়িবিশিষ্ট বৃদ্ধ লোকটি পীর সাহেব

৩১। ‘ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে’ কে পীর সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে?

উত্তর: ‘ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে’ এমদাদ পীর সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে থাকে

৩২। পীর সাহেবের মতে মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার কী হারাম?

উত্তর: পীর সাহেবের মতে মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার ধনদৌলত হারাম

৩৩। যেকেরে জলী কী?

উত্তর: উচ্চস্বরে জিকির

৩৪। যেকরে খফী কী?

উত্তর: নীরবে জিকির

৩৫। কুদরতে ইযদানী অর্থ কী?

উত্তর: স্রষ্টার মহিমা বা শক্তি

৩৬। ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের সুফী সাহেবের নাম কী?

উত্তর: ‘হুযুর কেবলা’ গল্পের সুফী সাহেবের নাম সাদুল্লাহ

৩৭। এমদাদ পীর সাহেবের নির্দেশে চোখ বুজে কী করতে থাকে?

উত্তর: এমদাদ পীর সাহেবের নির্দেশে চোখ বুজে ‘এলহু’ ‘এলহু’ করতে থাকে

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url