মহাপতঙ্গ গল্পের বিষয়বস্তু এবং আধুনিক সময়ে এর প্রাসঙ্গিকতা

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গল্পকার ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবু ইসহাকের একটি অনন্য গল্প হলো মহাপতঙ্গ। দেশ, কাল, পাত্রভেদে গল্পটি সব সময়েই প্রাসঙ্গিক। কেন এই গল্পটি কালজয়ী, তা আলোচনার আগে এর পটভূমি, চরিত্র ও ধারাবর্ণনা নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। গল্পটি মানুষের সভ্য বা অসভ্য আচরণের রূপকচিত্র, যেখানে মানবজাতির কর্মের ফলশ্রুতিতে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ধ্বংসের চিত্র ফুটে উঠেছে। মহাপতঙ্গ গল্পের মতোই লেখকের অন্যান্য রূপক গল্প সমাজ ও সভ্যতার গভীর সংকট তুলে ধরে।

মহাপতঙ্গ আবু ইসহাক
মহাপতঙ্গ-আবু ইসহাক 


আবু ইসহাক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নাম। ১৯৪৬ সালে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি লেখেন বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ি, যা ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এটি একটি সামাজিক উপন্যাস এবং এখনও পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার সাহিত্যকর্মে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের খণ্ডচিত্র যেমন উঠে এসেছে, তেমনই বাংলার স্বাধীনতা-পরবর্তী বাস্তবতাও প্রতিফলিত হয়েছে। স্বল্প রচনাসম্ভার থাকা সত্ত্বেও তার সাহিত্যকর্ম অসামান্য।


আবু ইসহাকের আরেকটি বিশেষ রূপক গল্প হলো জোঁক, যেখানে সমাজের কিছু মানুষের চরিত্রের সঙ্গে জোঁকের বৈশিষ্ট্যের তুলনা টানা হয়েছে। মহাপতঙ্গ গল্পেও সমগ্র মানবজাতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে সভ্যতা ধ্বংসের দায়ে। গল্পটি যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং মানবজাতির দ্বিমুখী চরিত্র—গঠন ও ধ্বংস উভয়ের প্রতিচ্ছবি। মানুষের বুদ্ধি, কর্মদক্ষতা এবং সভ্যতা গড়ার ক্ষমতার প্রশংসা করেও লেখক শেষ পর্যন্ত মানবজাতির প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন।


বর্তমান সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতা এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। যুদ্ধ সবসময় নির্বিচারে ধ্বংস ডেকে আনে। আবু ইসহাক মহাপতঙ্গ গল্পে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে পাখিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করেছেন। গল্পে দুটি চড়ুই পাখি মূল চরিত্র। তাদের ভাষায় যুদ্ধবিমান হলো "মহাপতঙ্গ"। পাখিদের দৃষ্টিতে মহাপতঙ্গ ডিম বহন করে, কিন্তু সেই ডিম আসলে বোমা, যা মাটিতে পড়ে সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।


গল্পটি শুরু হয় চড়ুই পাখির খাবার খোঁজার বর্ণনা দিয়ে। তারা যুদ্ধবিমানের শব্দ শুনে ভয় পায় এবং ভাবে, এ শব্দ হয়তো তাদের শোনা রাক্ষস-খোক্কসদের মতো বিপজ্জনক। গল্পের চড়ুই পাখি তাদের বাচ্চাদের রাক্ষসের ভয়াবহতা বোঝাতে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে, যেমন: "ম্যাও খোক্ষস" (বিড়াল), "কুণ্ডলী ফোঁস ফোঁস" (সাপ), "কাঁ ভোক্ষুস" (কাক), এবং "ছোঁ রাক্ষস" (চিল)। এর মাধ্যমেই লেখক কাহিনিতে ব্যঙ্গ এবং রূপকের ব্যবহার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন।


বন্যা, খরা, যুদ্ধ এবং দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে মহাপতঙ্গের কার্যকলাপ—কখনো মানুষকে সাহায্য করা, আবার কখনো তাদের ধ্বংস করা—গল্পের গভীর দার্শনিক বার্তা তুলে ধরে। চড়ুই দম্পতি মহাপতঙ্গকে খাদ্যবাহী মনে করে ছুটে যায়, কিন্তু মারণাস্ত্র বহনকারী সেই বিমান তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। গল্প শেষে তাদের "ছিঃ ছিঃ" ধিক্কার মানবজাতির প্রতি।


আবু ইসহাক গল্পে বিজ্ঞানের দ্বিমুখী ব্যবহার দেখিয়েছেন। বিজ্ঞান যেমন জীবন রক্ষা করে, তেমনি ধ্বংসও ডেকে আনে। মানুষের সভ্যতা গড়ার ক্ষমতা যেমন অসীম, তেমনি তার ধ্বংসাত্মক মানসিকতা একই সঙ্গে গল্পটিকে অনন্তপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।



আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ গল্পগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমান সময়ে এটি পার করছে ছয় দশক, যা বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এ দীর্ঘ সময়ে সাহিত্য ও সমাজ বদলে গেলেও গল্পগ্রন্থটির প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। ছোটগল্পের এমন একটি সংকলন, যা সময়ের পরীক্ষায় টিকে যায়, তা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উঠতেই পারে। গল্পগুলির প্রাসঙ্গিকতা, গভীরতা, অভিঘাত এবং সমকালীন বাস্তবতায় এদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। যে-ক্ষত নিরাময়ের জন্য আবু ইসহাক গল্পগুলি লিখেছিলেন, তা আজও কতটা সমাধান হয়েছে? এ থেকেই সামনে আসে তাঁর লেখকসত্তার দূরদৃষ্টি এবং গল্পগুলির মহাকালের প্রতি যাত্রার প্রসঙ্গ।


অনেক সাহিত্যকর্ম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা হারায় এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কেবল তথ্য হিসেবে টিকে থাকে। অন্যদিকে কিছু সাহিত্যকর্ম সময় অতিক্রম করে শিল্পমূল্যেও সমানভাবে উজ্জ্বল থাকে এবং কালজয়ী হয়ে ওঠে। মহাপতঙ্গ সেই দ্বিতীয় ধারায় পড়ে। এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি লেখা হয়েছিল ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে। প্রথম গল্প বিস্ফোরণ লেখা হয় ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে, আর শেষ গল্প বংশধর ১৯৫৯ সালের আগস্টে।


ষাট-সত্তর বছর পর যখন আমরা এই গল্পগুলির ভেতরে প্রবেশ করি, দেখা যায় আবু ইসহাক ভবিষ্যতের গল্প লেখেননি। তিনি তাঁর সময়ের গল্প বলেছেন। তবু গল্পগুলির অন্তর্নিহিত বার্তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বাহ্যিক সমাজ বদলালেও তার অন্দরমহল অনেকটাই অপরিবর্তিত। ষাট-সত্তর বছর আগেই আবু ইসহাক যে সমাজচিত্র এঁকেছিলেন, তা এখনো চমৎকারভাবে সমসাময়িক। তিনি জানতেন সমাজের আসল ক্ষত কোথায় এবং কীভাবে তা চিহ্নিত করতে হবে। তাঁর আঁকা এই সমাজচিত্র এখনও আমাদের চোখে বাস্তব মনে হয়।


আবু ইসহাকের গল্প নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর সরলরৈখিক কাঠামো। সমসাময়িক লেখকরা যখন গল্পে চিত্রকল্প ও বহুরৈখিকতা যোগ করার দিকে মনোযোগী ছিলেন, তখন তিনি বেছে নিয়েছিলেন সরলরৈখিক পদ্ধতি। এই কাঠামো প্রথমে একঘেয়ে স্কেচ মনে হলেও তিনি এতে প্রতীকের শৈল্পিক প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। প্রতীকগুলি স্কেচের প্রতিটি টানে এমনভাবে গেঁথে দিয়েছেন যে, তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই প্রতীক, শ্লেষ, কৌতুক এবং সুপ্ত প্রতিবাদ তাঁর গল্পকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।


মহাপতঙ্গ গল্পের সরল বর্ণনায় গভীর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে রয়েছে। গল্পের বাক্যে সুপ্ত অর্থ এমনভাবে গাঁথা হয়েছে, যা পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এতে গল্পগুলি সহজপাঠ্য এবং গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি পাঠকের সঙ্গে লেখকের মনোভঙ্গির গভীর সংযোগ স্থাপন করে। সরল ভাষার আড়ালে প্রতীকের মাধ্যমে যে বার্তা তিনি দিয়েছেন, তা আজও তীক্ষ্ণভাবে আমাদের ছুঁয়ে যায়।


এই গল্পগ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা শুধু শিল্পমূল্যে নয়, সামাজিক মূল্যেও অনন্য। আবু ইসহাক গল্পের মাধ্যমে সমাজের যে নেতিবাচক দিকগুলি চিহ্নিত করেছিলেন, তা এখনো সমানভাবে প্রকট। তাঁর ক্ষতচিহ্নিতকরণ একদিকে তৎকালীন সমাজকে যেমন সামনে নিয়ে এসেছে, তেমনি আজকের সমাজকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ কারণেই মহাপতঙ্গ গল্পগ্রন্থটি এখনো প্রাসঙ্গিক এবং উদাহরণীয়। এটি বাংলা কথাসাহিত্যে কালজয়ী সংযোজন হিসেবেই বিবেচিত।

১। মহাপতঙ্গ গল্পের বিষয়বস্তু 
২। মহাপতঙ্গ গল্পের মূলভাব 
৩। মহাপতঙ্গ গল্পের সমাজবাস্তবতা
৪। মহাপতঙ্গ গল্পের শিল্পমূল্য 
৫। মহাপতঙ্গ গল্পের রূপক
Next Post Previous Post
2 Comments
  • Nusrat Jahan
    Nusrat Jahan November 19, 2024 at 1:49 PM

    সুন্দর উপত্থাপনা।

  • MD ASIF KARIM
    MD ASIF KARIM November 19, 2024 at 11:46 PM

    ধন্যবাদ

Add Comment
comment url