ইউসুফ-জুলেখা: শাহ মুহাম্মদ সগীর এর কাব্য এবং কুরআনের কাহিনী

মধ্যযুগ থেকে বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক কাব্যের সূচনা হয়। এই ধারার প্রথম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায় শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্যে। এটি রচিত হয়েছিল গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪১১ খ্রিস্টাব্দ) পৃষ্ঠপোষকতায়। কাব্যটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানবীয় প্রেমকাহিনীর প্রথম অভিজ্ঞান।

রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান হিসেবে ইউসুফ জোলেখা
ইউসুফ জুলেখা


ইউসুফ-জুলেখা’র ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট:


‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাহিনীর মূল উৎস পবিত্র কোরআন ও বাইবেল। কোরআনে এটি একটি নৈতিক শিক্ষার প্যারাবল হিসেবে বর্ণিত হলেও, পরবর্তী সময়ে ইরানের কবি ফেরদৌসী ও সুফি কবি আবদুর রহমান জামী এই কাহিনীর রোমান্টিক দিককে উপজীব্য করে কাব্য রচনা করেন। শাহ্ মোহাম্মদ সগীর তাঁদের রীতিতে প্রভাবিত হয়ে বাংলায় ‘ইউসুফ-জুলেখা’ রচনা করেন।


কাব্যের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য:

কাব্যটি ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করেও মানবিক প্রেমের একটি কালজয়ী রূপ পেয়েছে। ইউসুফের সততা, সংযম এবং রূপের প্রতি জুলেখার আকর্ষণ কাব্যের কেন্দ্রে স্থাপিত। কিন্তু প্রেমের উত্তরণ ঘটে জুলেখার আত্মোৎসর্গ এবং সাধনার মধ্য দিয়ে। ফলে এটি শুধু রোমান্টিক প্রেমের কাব্য নয়; বরং ত্যাগ ও পবিত্রতার এক আধ্যাত্মিক আখ্যান।


কাব্যের ভাষা ও শৈলী:


শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের কাব্য অত্যন্ত সাবলীল ও মার্জিত। সত্তর অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বিশাল রচনা কোথাও জড়তা বা কৃত্রিমতার পরিচয় দেয় না। কাব্যের বিদেশি উৎস থাকলেও এর ভাষা, প্রকৃতি, এবং আবহ সম্পূর্ণভাবে বাংলার। চট্টগ্রামের কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাঁকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে মনে করেছেন।


ইউসুফ-জুলেখার গুরুত্ব ও প্রভাব:


বাংলা সাহিত্যে শাহ্ মোহাম্মদ সগীর কেবল ধর্মীয় আদর্শ প্রচারে থেমে থাকেননি; তাঁর রচনায় প্রেম, প্রকৃতি এবং মানবীয় আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি স্বীকার করেছেন, “প্রেমরসে ধর্মবাণী কহিমু ভরিয়া।” কাব্যে প্রেমের রসে ধর্মের চেয়ে মানববাণীই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।


‘ইউসুফ-জুলেখা’ মধ্যযুগের বাংলা রোমান্টিক কাব্যধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এর রূপ, বর্ণনা এবং মানবিক আবেদন আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এটি শুধু ধর্মীয় কাহিনীর রূপান্তর নয়; বরং বাঙালি জীবনের আবহে সিক্ত একটি সম্পূর্ণ রোমান্টিক উপাখ্যান।


ইউসুফ (আঃ) ও জুলেখার কাহিনী পবিত্র কুরআনের সূরা ইউসুফে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এটি কুরআনে অন্যতম সুন্দর এবং গভীর শিক্ষামূলক কাহিনী হিসেবে স্বীকৃত।


কাহিনীর সারসংক্ষেপ:


1. ইউসুফ (আঃ)-এর শৈশব ও স্বপ্ন:

ইয়াকুব (আঃ)-এর পুত্র ইউসুফ (আঃ) স্বপ্নে দেখেন, চন্দ্র, সূর্য ও এগারোটি তারা তাকে সেজদা করছে। এই স্বপ্ন ভবিষ্যৎ বাণীর ইঙ্গিত বহন করে যা পরে পূর্ণ হয়।


2. ভাইদের ষড়যন্ত্র:

ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি ইয়াকুব (আঃ)-এর বিশেষ স্নেহ ভাইদের মধ্যে হিংসার সৃষ্টি করে। তারা তাকে হত্যা করতে চায়, কিন্তু পরে কূপে ফেলে দেয়।


3. কূপ থেকে উদ্ধার ও দাসত্ব:

একটি কাফেলা ইউসুফকে কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরে নিয়ে যায় এবং আজিজে মিশরের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে।


4. জুলেখার প্রেম ও পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া:

জুলেখা, আজিজে মিশরের স্ত্রী, ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি তাকে কুকর্মে প্রলুব্ধ করতে চান, কিন্তু ইউসুফ (আঃ) তার চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করেন। ঘটনা জানাজানি হলে জুলেখা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে অন্য মহিলাদের সামনে ইউসুফকে হাজির করেন। মহিলারা তার রূপ দেখে বিমোহিত হয়।


5. কারাবাস ও নির্দোষ প্রমাণ:

জুলেখার অপবাদে ইউসুফকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে বাদশাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীতে মহিলাদের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তার নির্দোষতা প্রমাণিত হয়।


6. মিশরের শাসন ও সম্মানিত অবস্থান:

ইউসুফ (আঃ)-এর জ্ঞান ও দক্ষতার কারণে তিনি মিশরের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তার যোগ্যতায় দেশ দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায়।


7. জুলেখার পুনর্মিলন:

জুলেখার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ইউসুফ (আঃ)-এর প্রতি তার ভালোবাসা ও অনুতাপ প্রকাশ করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের বিয়ে হয় এবং সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন।


কাহিনীর শিক্ষা:


ধৈর্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল থাকা মানুষকে সাফল্যে পৌঁছায়।


আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাকওয়া সব ধরনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে দেয়।


পবিত্র চরিত্র ও আত্মসংযম মানুষের সর্বোচ্চ সম্মান নিশ্চিত করে।


সূরা ইউসুফের এই কাহিনী মানবজীবনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার এক চিরন্তন উদাহরণ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url