মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা কথাসাহিত্য
বাংলা কথাসাহিত্য একটি সময়োপযোগী শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। যদিও সাধারণত একাত্তর-পরবর্তী সাহিত্যকেই বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এর বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, আত্মপরিচয় ও স্বাধিকারের সংগ্রাম শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে সৃজনশীল সাহিত্যেও প্রভাব বিস্তার করে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন থেকে যে ধারাবাহিক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে, তা বাঙালি মানসকে জাগিয়ে তোলে এবং এর সাহিত্যিক প্রভাবও গভীরভাবে দৃশ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা কথাসাহিত্য |
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের শুরুর সময়কালকে ১৯৭১ সালের আগের সময় বলে ধরা হয়। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই সাহিত্যের মূল প্রেরণা হয়ে ওঠে, যা একসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিকশিত হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত জাতিগত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম একই সূত্রে গাঁথা ছিল। ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন' (১৯৬৯) এবং শহীদুল্লাহ কায়সারের 'সংশপ্তক' বাঙালি জীবনের দোলাচল ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, আহমদ ছফার 'ওঙ্কার' (১৯৭৫) প্রতীকী ভাষায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে উপস্থাপন করে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস ফুটে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কথাসাহিত্যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ক্রান্তিকাল ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন, আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরাত' (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যাযজ্ঞের বাস্তবতা তুলে ধরে। স্বাধীনতার পর রশীদ করীমের 'আমার যত গ্লানি' (১৯৭৩) এবং রশীদ হায়দারের 'খাঁচা' (১৯৭৫) অবরুদ্ধ ঢাকার চিত্র অঙ্কন করে। মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন' (১৯৭৬) একজন তরুণের আত্মোপলব্ধির কাহিনি এবং শওকত আলীর 'যাত্রা' (১৯৭৬) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। সেলিনা হোসেনের 'হাঙ্গর নদী গ্রেনেড' মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে গল্পনির্ভর ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে, যা পাঠককে মর্মস্পর্শী অনুভূতি প্রদান করে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন নারী নির্যাতন ও বীরাঙ্গনাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে রিজিয়া রহমানের 'রক্তের অক্ষর' (১৯৭৮) এবং 'হে মহাজীবন' (১৯৮৩) সমাজের বিত্তশালীদের বিকৃত মানসিকতা ও নারীদের দুর্দশার বর্ণনা দেয়। শাহীন আখতারের 'তালাস' (২০০৪) মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের বীরাঙ্গনাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তথ্যনির্ভর দলিলস্বরূপ। সৈয়দ শামসুল হকের 'অন্তর্গত' (১৯৮৪) মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও সমাজের প্রতিকূলতা চিত্রায়িত করে।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার সঙ্গে এত গভীরভাবে সম্পৃক্ত যে, বাংলাদেশে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা সচেতন বা অবচেতনে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়াতে পারেন না। কোনো না কোনোভাবে তাঁদের সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের ছাপ দেখা যায়; তা গল্প-উপন্যাসে হোক, কবিতা-গানে, ছড়া-নাটকে, প্রবন্ধে কিংবা স্মৃতিচারণে।
প্রশ্ন হলো, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের তুলনায় যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি বা দেখলেও তা স্পষ্ট মনে নেই, কিংবা যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা কি সেই রক্তাক্ত সময়ের উত্তাপ, স্বাধীনতার স্পৃহা, আবেগ ও উৎকণ্ঠা, বেঁচে থাকার আকুতি এবং লড়াইয়ের মনস্তত্ত্ব ততটা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন?
কারণ, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর পড়াশোনা থেকে অর্জিত জ্ঞান অনুভূতির তীব্রতায় সমান হয় না। তবে এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত সাহিত্য রচনা হয়েছে, যা ঐতিহাসিক ঘটনার বহু বছর পর। লেখকের পঠন অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি ও দক্ষতার সমন্বয়ে অতীত ও বর্তমানের মেলবন্ধন সম্ভব হয়েছে।
শওকত ওসমান, আনোয়ার পাশা, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, সেলিনা হোসেন ও হুমায়ূন আহমেদ, এঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও অত্যাচারের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। অন্যদিকে, আনিসুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় শিশু ছিলেন। তবুও তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে দারুণ মুনশিয়ানা রয়েছে। শওকত ওসমানের 'জাহান্নাম হইতে বিদায়', আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরত', সৈয়দ শামসুল হকের 'নীল দংশন', মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন', সেলিনা হোসেনের 'নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি', হুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামল ছায়া' প্রভৃতি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবেদনা উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
এসব রচনা কল্পনানির্ভর হলেও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতা, মা-বোনদের ওপর নির্যাতন, যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস এ উপন্যাসগুলিতে সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। এ উপন্যাসগুলো যেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেই শওকত ওসমানের 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' এবং আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রোটি আওরত' উপন্যাস দুটির সৃষ্টি হয়েছে। শওকত ওসমান উপন্যাসটিতে এক প্রবীণ শিক্ষকের দৃষ্টিতে দেশত্যাগের বেদনা ও পাক বাহিনীর অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন। আনোয়ার পাশার উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে, সেই রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের হত্যাযজ্ঞ এবং প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহিনের চিন্তা, যাঁর মাধ্যমে সমাজের রাজাকার মানসিকতা ও পাকিস্তানপ্রীতির কুৎসিত রূপটি প্রকাশিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা দক্ষতার সঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদী গ্রেনেড' এবং আনিসুল হকের 'মা' উপন্যাসে। 'হাঙর নদী গ্রেনেড'-এ এক সাধারণ গ্রামের মায়ের দেশের প্রতি আত্মত্যাগকে তুলে ধরা হয়েছে, যিনি নিজের সন্তানকে উৎসর্গ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষায়। আনিসুল হকের 'মা' উপন্যাসে এক শহীদের মা'র গভীর ত্যাগ ও দেশের প্রতি তার অবিচল নিষ্ঠা মর্মস্পর্শীভাবে চিত্রিত হয়েছে।
এসব উপন্যাস নানা দিক থেকে সমালোচিত হতে পারে, কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জটিল মনোজগত ও সমাজের প্রতিচ্ছবি এদের মধ্যেই অমর হয়ে আছে। এ ধরনের সাহিত্যকর্ম পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের মধ্যে দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে তুলবে।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের অবদান অসীম। এতে একদিকে দেখা যায় দেশের ঐতিহাসিক পরম্পরা, আরেকদিকে দেশ ও মানুষের আত্মিক রূপান্তর। বাংলা কথাসাহিত্য মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিফলিত করে ব্যক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় স্তরে বাঙালির পরিচয়, সংস্কৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষার উজ্জ্বল দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা এ জাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে ভবিষ্যতের জন্যও মূল্যবান।
Wow great keep it up
ধন্যবাদ
Great!!! 👍
ধন্যবাদ