রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে 'গোরা' উপন্যাসের সার্থকতা

'গোরা' উপন্যাসটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপন্যাসে রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জাতীয়তাবাদের সূক্ষ্ম দিকগুলো অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। গোরা উপন্যাসের রাজনৈতিক সার্থকতা নিম্নলিখিত দিকগুলোতে বিশ্লেষণ করা যায়:


গোরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে গোরা 


১. জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন

গোরা উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি সমাজে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং বিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে। গোরা চরিত্রটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এক প্রতীক, যার মধ্যে দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মানসিকতা স্পষ্ট। তিনি মনে করেন, ভারতীয়ত্ব রক্ষার জন্য হিন্দু ধর্মকেই জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন উপন্যাস "গোরা"র মূল থিমগুলোর মধ্যে একটি এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বুনেছেন। গোরা উপন্যাসে জাতীয়তাবাদকে বহুমুখীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যেখানে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্যে দিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অর্থ এবং এর সীমাবদ্ধতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "গোরা" রচিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। এটি এমন একটি সময়, যখন ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক নীতি, সমাজের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, এবং ভারতীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান আত্মসচেতনতার প্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে। এই সময় ভারতীয় সমাজে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক বিভাজনের পাশাপাশি ঐক্যের জন্যও একটি প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছিল।

উপন্যাসে গোরা নামের প্রধান চরিত্রটি এই জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে উদ্ভাসিত হয়। সে একজন কট্টর হিন্দু এবং জাতীয়তাবাদী, যে মনে করে ভারতের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষার জন্য হিন্দু ধর্মকেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এই চিন্তা রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না, তবে তিনি এটি ব্যবহার করেছেন জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা এবং তার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব প্রকাশ করার জন্য।


গোরা চরিত্রটি জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি শক্তিশালী প্রতিমূর্তি। তার জাতীয়তাবাদ প্রধানত হিন্দুধর্মের প্রতি গভীর আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সে বিশ্বাস করে যে, ভারতের স্বাধীনতা এবং প্রকৃত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমে হিন্দু ধর্মকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গোরা মনে করে, ভারতের অতীত গৌরবময় সভ্যতা এবং সংস্কৃতি হিন্দুধর্মের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে, এবং এই ধর্মই জাতীয়তাবাদের মূল চালিকা শক্তি হতে পারে। তার দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর, এবং ধর্মীয় পরিচয়কেই সে সর্বাগ্রে স্থান দেয়।

গোরা এমন একটি চরিত্র, যার ব্যক্তিত্বের মূল চালিকা শক্তি হল ভারতীয় ঐতিহ্য এবং হিন্দু ধর্মের প্রতি গভীর আনুগত্য। তার কাছে জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়, এটি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই কারণে, গোরা মনে করে যে, ভারতের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধি তখনই আসবে, যখন ভারতীয় সমাজ হিন্দুধর্মের আদর্শে পুনর্গঠিত হবে এবং ব্রিটিশ শাসনের সমস্ত প্রভাব থেকে মুক্তি পাবে।

গোরা চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। গোরা যে জাতীয়তাবাদ ধারণ করে, তা মূলত ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি বিশ্বাস করেন, হিন্দু ধর্মই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত পরিচয় এবং এর ভিত্তি। তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অন্য ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু করে তোলে, বিশেষ করে ব্রাহ্ম ধর্ম এবং মুসলমানদের প্রতি।

রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। গোরা চরিত্রের ভেতরে যে দ্বন্দ্ব কাজ করে, তা আসলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদেরই একটি প্রতিফলন। গোরা যখন জানে যে, সে প্রকৃতপক্ষে একজন খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান, তখন তার বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর একটি গভীর আঘাত আসে। সে বুঝতে পারে, জাতীয়তাবাদ যদি কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তবে তা প্রকৃত অর্থে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তার এই উপলব্ধি গোরা চরিত্রের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তনের সূচনা করে।

উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে গোরা বুঝতে পারে যে, জাতীয়তাবাদ কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে নির্মাণ করা যায় না। জাতীয়তাবাদের প্রকৃত ভিত্তি হওয়া উচিত মানবিকতা এবং সার্বজনীন চেতনা, যেখানে ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে একতা স্থাপন করা যায়। গোরা যখন নিজের খ্রিস্টান পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে, তখন সে উপলব্ধি করে যে, তার পূর্বেকার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সংকীর্ণ এবং বিভাজনমূলক।

এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গোরা উপলব্ধি করে যে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ তখনই সার্থক হয়, যখন তা ধর্ম, বর্ণ, এবং জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন, জাতীয়তাবাদ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা, যা কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। গোরা চরিত্রের এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের সার্বজনীনতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের নিজের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে গোরা চরিত্রের জাতীয়তাবাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজে জাতীয়তাবাদী হলেও তিনি কখনোই ধর্মীয় পরিচয়কে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তিনি মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ হওয়া উচিত এমন একটি আদর্শ, যা সকল ধর্ম, বর্ণ, এবং সম্প্রদায়কে একত্রিত করে।

গোরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেছেন, যা কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন, এই ধরনের জাতীয়তাবাদ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে বিভাজিত করে এবং প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। গোরা চরিত্রের শেষ পর্যায়ের পরিবর্তনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তার নিজের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, যেখানে জাতীয়তাবাদ মানবিকতা, সহানুভূতি, এবং সমতা দ্বারা পরিচালিত হয়।

"গোরা" উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বহুমুখী দিক তুলে ধরেছেন। গোরা চরিত্রটি একদিকে সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক, অন্যদিকে সে নিজেই নিজের চিন্তার পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এই দ্বৈত চরিত্রায়নের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, জাতীয়তাবাদ একটি বিকাশমান চেতনা, যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত এবং পরিশীলিত হয়।

উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র, যেমন বিনয়, আনন্দময়ী, এবং সুচরিতা, এই জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করে। বিনয়, যিনি গোরা'র নিকটতম বন্ধু, তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের প্রতি এক ধরনের মিশ্র মনোভাব রয়েছে। আনন্দময়ী, গোরা'র পালক মা, তার মধ্যে মাতৃত্ব এবং মানবতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়, যা গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করে।

২. ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

গোরা উপন্যাসে ধর্ম এবং রাজনীতির সংঘাত অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গোরা নিজেকে একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে ভাবেন, কিন্তু উপন্যাসের শেষে তিনি জানতে পারেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন আইরিশ খ্রিস্টান। এই পরিচয় প্রকাশের পর, গোরা উপলব্ধি করেন যে সত্যিকারের দেশপ্রেম ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের উপর নির্ভর করতে পারে না; তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানুষের মানবিকতা এবং সার্বজনীন চেতনা।

ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব উপন্যাস "গোরা"র অন্যতম প্রধান থিম এবং এর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় সমাজের জটিলতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন তুলে ধরেছেন। "গোরা" উপন্যাসে ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, এবং রাজনীতির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গোরা চরিত্রের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে।

উপন্যাসের মূল চরিত্র গোরা একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী, যার বিশ্বাস হিন্দু ধর্মই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। গোরা মনে করে, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পেতে হলে ভারতের মানুষকে হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং তার উপর ভিত্তি করেই ভারতের প্রকৃত আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তবে, তার এই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। যেমন, সুচরিতা এবং বিনয় ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী এবং তাদের চিন্তাভাবনা এবং মূল্যবোধ গোরা'র চেয়ে ভিন্ন।

গোরা উপন্যাসে ধর্ম এবং রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। একদিকে গোরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখে, অন্যদিকে অন্যান্য চরিত্র ধর্মকে পৃথক একটি সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে এবং রাজনীতিকে ধর্মের থেকে পৃথক করতে চায়। এর ফলে গোরা'র সঙ্গে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং উপন্যাসের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

গোরা চরিত্রে ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। গোরা মনে করে, হিন্দু ধর্মই প্রকৃত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক এবং ভারতীয় সমাজের পুনর্গঠন করতে হলে হিন্দু ধর্মের আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার এই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু করে তোলে এবং সে ব্রাহ্ম ধর্ম, খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।

গোরা'র এই সংকীর্ণতা তাকে রাজনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য করে। সে মনে করে, হিন্দু ধর্মের বাইরে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণযোগ্য নয় এবং ভারতীয় সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। এই সংকীর্ণতা তাকে সুচরিতা, বিনয়, এবং আনন্দময়ীর মতো চরিত্রগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত করে এবং তার রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ব্রাহ্মধর্ম "গোরা" উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রাহ্মধর্ম মূলত একটি উদার ধর্মীয় আন্দোলন, যা হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নতুন সমাজ ও সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করে। ব্রাহ্মধর্মের অনুসারীরা মনে করে, ধর্ম এবং রাজনীতি আলাদা হওয়া উচিত এবং সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য ধর্মের চেয়ে মানবিকতা এবং নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

গোরা'র সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের এই মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। গোরা মনে করে, ব্রাহ্মধর্ম হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে এবং তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, সুচরিতা এবং বিনয় ব্রাহ্মধর্মের মাধ্যমে সমাজে উদারতা, শিক্ষা, এবং সংস্কারের বার্তা ছড়াতে চায়। এই দ্বন্দ্ব উপন্যাসের মূল সংঘাতগুলোর একটি এবং এটি ধর্ম এবং রাজনীতির সম্পর্ককে জটিল করে তোলে।

"গোরা" উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি কী হবে? গোরা মনে করে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় ভিত্তির উপর দাঁড় করানো উচিত, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের উপর। তার মতে, ধর্মীয় ঐতিহ্যই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তির মূল চাবিকাঠি। এই দৃষ্টিভঙ্গি গোরা'র ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে প্রতিফলিত করে, কারণ সে অন্য ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের লোকদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখতে অস্বীকার করে।

গোরা'র এই দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। বিনয়, সুচরিতা এবং আনন্দময়ী গোরা'র এই দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তারা মনে করে, ধর্মীয় ভিত্তির উপর রাজনীতি দাঁড়াতে পারে না। বরং, জাতীয়তাবাদ হওয়া উচিত সর্বজনীন এবং সার্বিক, যেখানে ধর্মীয় বিভেদকে পিছনে ফেলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

গোরা'র জীবনে ধর্ম এবং রাজনীতির দ্বন্দ্ব শুধু তার রাজনৈতিক চিন্তাধারাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার ব্যক্তিগত জীবনেও গভীর প্রভাব ফেলে। গোরা শুরু থেকেই নিজেকে একজন কট্টর হিন্দু এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হিসেবে মনে করে। তবে, উপন্যাসের এক পর্যায়ে সে জানতে পারে যে, সে আসলে একজন আইরিশ খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান। এই সত্য প্রকাশ গোরা'র ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের উপর এক গভীর আঘাত হানে।

গোরা'র এই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব তার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে যে, তার পূর্বেকার বিশ্বাস এবং মতাদর্শ আসলে ভ্রান্ত ছিল এবং ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় কিছু হলো মানবিকতা এবং সর্বজনীনতা। এই উপলব্ধি গোরা'র রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যেখানে সে ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের প্রকৃত একতা এবং সমতার আদর্শ গ্রহণ করে।

"গোরা" উপন্যাসের প্রতিটি প্রধান চরিত্রের মধ্যে ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা যায়। যেমন, বিনয় একজন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও সে গোরা'র বন্ধু এবং তার প্রতি গভীর আনুগত্য দেখায়। তবে, গোরা'র কঠোর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিনয় সম্পূর্ণ একমত নয়। সে ধর্মের বাইরে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চায় এবং সমাজের সংস্কার করতে চায়।

সুচরিতা, একজন ব্রাহ্ম নারী, গোরা'র প্রতি একটি গভীর আকর্ষণ অনুভব করলেও তার ধর্মীয় সংকীর্ণতার সঙ্গে কখনোই পুরোপুরি একমত হতে পারে না। সুচরিতা মনে করে, জাতীয়তাবাদ হওয়া উচিত ধর্মনিরপেক্ষ এবং মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা। সে ধর্মীয় সংস্কার এবং নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করতে চায়, যা গোরা'র দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে।

"গোরা" উপন্যাসে ধর্মীয় পুনর্জাগরণ এবং সমাজ সংস্কারের মধ্যে দ্বন্দ্বও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। গোরা মনে করে, হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তির একমাত্র উপায় এবং সমাজের সংস্কার করতে হলে প্রথমে ধর্মীয় ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার মতে, ধর্মই সমাজের মূল ভিত্তি এবং এর বাইরে কোনো সমাজ সংস্কার সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, বিনয়, সুচরিতা এবং ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারীরা মনে করে, ধর্মীয় পুনর্জাগরণের চেয়ে সমাজের সংস্কার এবং শিক্ষার প্রসার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ধর্মের চেয়ে মানবিক মূল্যবোধকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে চায়। এই দ্বন্দ্ব ধর্ম এবং রাজনীতির সম্পর্ককে জটিল করে তোলে এবং উপন্যাসে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় যে, সমাজের উন্নয়নের জন্য কোন পথটি বেছে নেওয়া উচিত।

গোরা উপন্যাসের মূল শিক্ষা ও বার্তাগুলোর একটি হলো ধর্ম এবং রাজনীতিকে পৃথকীকরণের প্রয়োজনীয়তা। গোরা চরিত্রের উন্নতির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনীতি দাঁড় করানো একটি ভুল পন্থা হতে পারে। ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যক্তির নিজস্ব এবং তা তার ব্যক্তিগত জীবনের অংশ হওয়া উচিত, কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালনা এবং জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি ধর্মের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।

গোরা যখন তার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারে এবং তার হিন্দু ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তখন সে উপলব্ধি করে যে, ধর্ম এবং রাজনীতি একে অপরের থেকে পৃথক করা জরুরি। মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়, এবং সমতার ভিত্তিতে রাজনীতি গড়ে উঠতে হবে। এই উপলব্ধি তাকে একটি সার্বজনীন এবং মানবিক জাতীয়তাবাদের পথে পরিচালিত করে, যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ, এবং সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

গোরা উপন্যাসে ধর্ম এবং রাজনীতির পৃথকীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্র, যেমন সুচরিতা, বিনয়, এবং আনন্দময়ী, এই বার্তার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। তারা ধর্মের বাইরে গিয়ে মানবতার ভিত্তিতে সমাজকে একত্রিত করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে সুচরিতা এবং বিনয় তাদের ব্রাহ্ম ধর্মীয় মূল্যবোধের মাধ্যমে দেখায়, ধর্মীয় সংহতি এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাইরে যেতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গি গোরা'র ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গোরা যখন বুঝতে পারে যে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ সম্ভব নয়, তখন তার মধ্যে একটি বড় মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন জাতীয়তাবাদী চিন্তার সূচনা করেছেন, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, এবং সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ ভুলে এক সার্বজনীন জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "গোরা" উপন্যাসে ধর্ম এবং রাজনীতির জটিল সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গোরা চরিত্রের মাধ্যমে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতা এবং তার বিপরীতে সার্বজনীন মানবিক জাতীয়তাবাদের ধারণা উপস্থাপন করা হয়েছে। গোরা'র ব্যক্তিগত জীবনের পরিবর্তন এবং তার চিন্তাধারার বিবর্তন ধর্ম এবং রাজনীতির পৃথকীকরণের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।

রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, জাতীয়তাবাদ এবং রাজনীতি ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে হবে। এই বার্তা আজও প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে এমন সমাজে, যেখানে ধর্ম এবং রাজনীতি প্রায়ই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। "গোরা" উপন্যাসের দ্বন্দ্ব, সংলাপ এবং চরিত্রের বিবর্তন আমাদের একটি সমন্বিত এবং মানবিক সমাজ গঠনের পথে অনুপ্রেরণা দেয়, যেখানে ধর্মীয় বিভেদ নয়, বরং মানবিকতা এবং ন্যায়বিচার প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।


৩. সমাজ সংস্কার ও রাজনীতি

উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথ শুধু রাজনীতি নয়, সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন। ব্রাহ্মধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব, নারীর অধিকার, কুসংস্কার, এবং সমাজের উচ্চ-নীচ বিভাজন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়। তিনি দেখিয়েছেন, একটি প্রকৃত রাজনৈতিক আন্দোলন তখনই সার্থক হবে, যখন তা সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "গোরা" উপন্যাসে সমাজ সংস্কার ও রাজনীতি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই উপন্যাসে ঠাকুর ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, ধর্ম, এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে অত্যন্ত জটিলভাবে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা এবং অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে সমাজ সংস্কার ও রাজনীতির ধারণাগুলোর উপর নানা দ্বন্দ্ব এবং বৈপরীত্য দেখা যায়। এখানে সমাজের প্রথা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং রাজনীতির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের ইচ্ছাকে কীভাবে পরিচালনা করা উচিত, সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীর আলাপ উঠে আসে।

রবীন্দ্রনাথের "গোরা"তে সমাজ সংস্কারের প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঔপনিবেশিক ভারতের সামাজিক অবস্থা, বিশেষ করে হিন্দু সমাজের রীতিনীতি এবং ধর্মীয় প্রথার প্রতি লেখক এক গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের একাধিক চরিত্র সমাজের প্রচলিত অনিয়ম ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দেয়।

উপন্যাসের সমাজ সংস্কারের প্রেক্ষাপটকে বোঝার জন্য প্রধানত দুইটি দিক বিবেচনা করতে হয়:

1. হিন্দু সমাজের প্রথা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা: গোরা চরিত্রটি হিন্দু ধর্মের প্রতি একটি দৃঢ় আস্থা পোষণ করে। সে বিশ্বাস করে, হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের মধ্যেই ভারতীয় সমাজের উত্তরণ সম্ভব। তবে, এই সংকীর্ণতার মধ্যেই সমাজ সংস্কারের প্রশ্নটি বড় হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ, এবং ধর্মের নামে সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে।

2. ব্রাহ্ম সমাজের উদারপন্থা: ব্রাহ্ম ধর্ম, যার অনুসারী বিনয়, সুচরিতা ও আনন্দময়ীর মতো চরিত্ররা, হিন্দু ধর্মের কঠোরতা ও সংকীর্ণতার বিপরীতে এক উদার, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। ব্রাহ্ম সমাজ মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের একটি আন্দোলন, যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে মুক্তির জন্য কাজ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মকে সংস্কার করে একটি আধুনিক, প্রগতিশীল সমাজ গঠন করা।

গোরা এবং ব্রাহ্ম সমাজের চরিত্রগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য সমাজ সংস্কার ও ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্রীয় থিম হিসেবে তুলে ধরে। গোরা হিন্দু ধর্মকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে দেখে, কিন্তু তার মতবাদ ব্রাহ্ম সমাজের উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সরাসরি বিরোধিতায় চলে আসে।



"গোরা" উপন্যাসে রাজনীতি এবং সমাজ সংস্কারের মধ্যে দ্বন্দ্ব অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ঔপনিবেশিক ভারত, যেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠছে। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদ কোন পথে যাবে—ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নাকি একটি সার্বজনীন মানবতাবাদ—এই প্রশ্নটি গোরা চরিত্রের মধ্য দিয়ে সামনে আসে।

গোরা, একজন জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদী, মনে করে যে ভারতের মুক্তি এবং সামাজিক পরিবর্তন হিন্দু ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব। তার মতে, জাতীয় ঐক্য অর্জন করতে হলে ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করতে হবে। তবে, গোরা'র এই দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ সংস্কারের সাথে এক ধরনের বিরোধ সৃষ্টি করে। কারণ, হিন্দু সমাজের প্রথা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ এবং নারীদের উপর যে অত্যাচার চালায়, তা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায়।

অন্যদিকে, ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্বে থাকা চরিত্ররা মনে করে যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চেয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্ম সমাজের চরিত্রগুলি সমাজের নিচু শ্রেণি এবং নারীদের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করতে চায়, যা গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। বিনয়, সুচরিতা, এবং আনন্দময়ীর মতো চরিত্ররা ধর্ম এবং রাজনীতিকে পৃথক করে সমাজের প্রগতির দিকে মনোনিবেশ করতে চায়।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা একটি প্রতীকী চরিত্র হিসেবে কাজ করে। প্রথমে সে একজন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী, যার বিশ্বাস যে ভারতের স্বাধীনতা এবং পুনর্জাগরণ হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনের উপর নির্ভর করে। তবে, তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সমাজ সংস্কারের ধারণার সরাসরি সংঘাত ঘটে। গোরা মনে করে যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদই সমাজের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত, কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি তার এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে।

গোরা'র ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তার পরিচয়ের পরিবর্তন তাকে একটি বিশাল মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়। উপন্যাসের এক পর্যায়ে গোরা জানতে পারে যে সে আসলে হিন্দু নয়, বরং একজন আইরিশ খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান। এই সত্য উদ্ঘাটন গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয় এবং তার চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটায়। সে বুঝতে পারে যে ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে একটি বড় ফাঁক রয়েছে।

এই রূপান্তর গোরা'কে একটি সার্বজনীন, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে শেখায়। তার পরিবর্তনশীল অবস্থান উপন্যাসের সমাজ সংস্কার এবং রাজনীতির মধ্যে সম্পর্কের জটিলতাকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলে। গোরা'র এই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছেন যে, সমাজের প্রকৃত উন্নতি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে মানুষের প্রতি মানবিকতার মধ্য দিয়ে আসতে পারে।

"গোরা" উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলোর মাধ্যমে সমাজের নারীর প্রতি অবস্থান এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়েছে। সুচরিতা এবং ললিতা দুটি ভিন্ন ধরনের নারী চরিত্র হলেও তারা সমাজের পরিবর্তন এবং সংস্কারের প্রতি আগ্রহী। বিশেষ করে ব্রাহ্ম সমাজের চরিত্রগুলোর মধ্যে নারীর মুক্তি এবং শিক্ষা নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা সেই সময়ের প্রথাগত সমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সুচরিতা, একজন ব্রাহ্ম নারী, ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে নারী অধিকার, শিক্ষা, এবং সামাজিক সমতার পক্ষে কাজ করতে চায়। গোরা চরিত্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজের প্রথা এবং নারী মুক্তির প্রশ্নেও তাদের মতবিরোধ দেখা যায়। এই নারী চরিত্রগুলো উপন্যাসে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এবং নারীর অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার দিকটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

"গোরা" উপন্যাসের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের রাজনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব এবং তার বিরোধিতা একটি বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। গোরা'র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে এবং সে মনে করে যে ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব।

তবে, ব্রাহ্ম সমাজের উদারপন্থী সদস্যরা একটি ভিন্ন পথে সমাজের উন্নয়ন এবং সংস্কারের কথা ভাবেন। তারা মনে করে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজের শিক্ষার উন্নয়ন, নারীর অধিকার, এবং ধর্মীয় বৈষম্য দূর করাই আসল সংস্কারের পথ।

৪. ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা

গোরা চরিত্রের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিরোধিতার রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন। যদিও গোরা প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন যে, জাতির আসল মুক্তি অর্জন করতে হলে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "গোরা" উপন্যাসে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় জটিলতার মধ্যে লেখক এই চেতনাকে বহুমাত্রিকভাবে তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশ শাসনকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে যে ধরনের মতবিরোধ এবং বিভাজন তৈরি হয়েছিল, তা এই উপন্যাসের মূল কাঠামোতে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা এবং অন্যান্য চরিত্রগুলোর চিন্তাধারা এবং তাদের রাজনৈতিক দর্শন ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদকে প্রতিফলিত করে।


"গোরা" উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হলো ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগের ভারতবর্ষ, যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভারত শাসন করছিল। এই সময়ে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে একটি জাগরণ শুরু হয়েছিল, যা মূলত জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে অস্থিরতা এবং বিরোধের উদ্ভব হয়েছিল। ভারতের জনগণ উপলব্ধি করতে শুরু করে যে, বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর অধীনে তাদের স্বাধীনতা ও স্বাভিমানের স্থান নেই।

এই ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার প্রধান উপাদান ছিল জাতীয়তাবাদ, যা ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম, এবং ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানায়। "গোরা" উপন্যাসে গোরা চরিত্রের মধ্যে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবলভাবে উপস্থিত। গোরা মনে করে, হিন্দু ধর্ম এবং ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যেই জাতির মুক্তির পথ নিহিত। সে বিশ্বাস করে যে ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে হবে।

গোরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, গোরা, মূলত একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী, যার মনের গভীরে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তীব্র বিরোধিতা বিরাজ করে। তার বিশ্বাস যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং সামাজিক মুক্তি কেবলমাত্র হিন্দু ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব। গোরা মনে করে, ভারতীয় সমাজের মূল ভিত্তি হলো হিন্দু ধর্ম, এবং এই ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কারগুলো পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

গোরা'র রাজনৈতিক দর্শন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, এবং এই জাতীয়তাবাদ একটি ধর্মীয় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার ক্রোধ এবং বিদ্রোহ কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নয়, বরং তার ধারণা অনুযায়ী একটি প্রাচীন এবং মহৎ জাতির পুনরুজ্জীবনের জন্য। ব্রিটিশদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সমাজব্যবস্থা তার কাছে ভারতীয় সমাজকে বিভক্ত এবং দুর্বল করার একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে হয়।

গোরা মনে করে যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে হলে ভারতের মানুষকে তাদের নিজের ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য দেখাতে হবে। তার বিশ্বাস, হিন্দু ধর্মের শক্তি এবং ঐতিহ্যই হলো ভারতবর্ষের মূল ভিত্তি, এবং এই ভিত্তিকে পুনরুদ্ধার করতে পারলেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।

হিন্দু ধর্মের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে দৃষ্টিভঙ্গি গোরা গ্রহণ করেছে, তা উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ থিম হয়ে উঠেছে। সে মনে করে, হিন্দু ধর্ম হলো ভারতের আসল পরিচয়, এবং এই পরিচয়ই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। গোরা'র বিশ্বাস যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি ধর্মীয় দায়িত্ব, এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সমাজের মুক্তির একমাত্র পথ।

উপন্যাসে গোরা চরিত্রের ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। বিশেষ করে বিনয়, সুচরিতা, এবং আনন্দময়ী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মেলে না।

বিনয়, গোরা'র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারী এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি গোরা'র থেকে অনেকটাই আলাদা। বিনয় মনে করে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে ধর্মীয় সংকীর্ণতার বাইরে যেতে হবে। সে বিশ্বাস করে, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে হলে ভারতীয় সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ এবং সমতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

সুচরিতা, ব্রাহ্ম পরিবারে বড় হওয়া একটি শিক্ষিত এবং প্রগতিশীল মেয়ে, গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আরো উদার এবং সে বিশ্বাস করে, সমাজের উন্নতি এবং ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের মূলমন্ত্র হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, এবং সামাজিক সমতা। সুচরিতা মনে করে, ধর্ম এবং রাজনীতি একে অপরের থেকে পৃথক হওয়া উচিত এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সর্বধর্ম সমন্বয় এবং মানবতার ভিত্তিতে এগোতে হবে।

আনন্দময়ী, গোরা'র পালক মা, তার স্নেহময়ী এবং উদারপন্থী চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের প্রতি একটি গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করলেও তা কেবলমাত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নয়। তার মতে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে ভারতীয় সমাজের ভেতরের অন্যায়, অত্যাচার এবং বৈষম্য দূর করতে হবে। আনন্দময়ীর বিশ্বাস যে জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে ভারতবাসীকে এক হতে হবে।

"গোরা" উপন্যাসের এক পর্যায়ে গোরা যখন জানতে পারে যে সে আসলে একজন হিন্দু নয়, বরং একজন আইরিশ খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান, তখন তার জীবনের প্রতি এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি বড় পরিবর্তন আসে। এই সত্য জানার পর, গোরা'র ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার মধ্যে একটি মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।

গোরা বুঝতে পারে যে তার এতদিনের বিশ্বাস এবং তার জাতীয়তাবাদী চেতনা কেবলমাত্র ধর্মের ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু এই ধর্মীয় পরিচয়ই ছিল ভুল। তার এই উপলব্ধি তাকে একটি বৃহত্তর, সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বাধ্য করে, যেখানে জাতি, ধর্ম, এবং সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ আর কোনো অর্থ বহন করে না। গোরা'র এই মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছেন যে, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম কেবলমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতার ওপর নির্ভর করে সফল হতে পারে না।

গোরা উপন্যাসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা চরিত্রগুলো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। ব্রাহ্ম সমাজের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। ব্রাহ্ম সমাজের অনুসারীরা মনে করে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ভারতীয় সমাজকে প্রাচীন ধর্মীয় প্রথা এবং রীতির ওপর নির্ভর না করে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, এবং মানবিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করতে হবে।

বিনয় ও সুচরিতা ব্রাহ্ম সমাজের উদার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে এবং তাদের মতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে ভারতীয় সমাজকে ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজের প্রগতির জন্য কাজ করতে হবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রিটিশ শাসনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেবল ধর্ম নয়, বরং মানবতা, শিক্ষা, নারীর অধিকার এবং সমাজের সব স্তরের উন্নয়ন জরুরি। এই চিন্তাধারা গোরা'র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের থেকে আলাদা। ব্রাহ্ম সমাজের লোকেরা মনে করে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য প্রথমে সমাজের ভেতরের অসঙ্গতি, যেমন জাতিভেদ প্রথা, নারী নির্যাতন, এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে দূর করতে হবে।

"গোরা" উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সুচরিতা ও ললিতা, ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় একটি মানবিক এবং শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজের নারীদের মুক্তি এবং তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

সুচরিতা যেমন প্রগতিশীল আদর্শ ধারণ করে, তেমনি ললিতা ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে তার নিজের স্বাধীনতা এবং আত্মসম্মানের প্রশ্নে। এই নারী চরিত্রগুলো দেখায় যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা কেবল পুরুষদের লড়াই নয়, বরং নারীরাও এ লড়াইয়ে সমানভাবে অংশগ্রহণ করছে। তারা ধর্মীয় বা সামাজিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে নারীর অধিকার এবং তাদের ভূমিকার পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেয়।

"গোরা" উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ভারতীয় সমাজে বিভাজন এবং দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতীয় সমাজে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মতাদর্শের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। একদিকে গোরা'র মতো কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী, অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল চরিত্ররা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়। এই মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের পথে প্রধান বাধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

গোরা'র দৃষ্টিতে হিন্দু ধর্ম হলো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার, কিন্তু অন্যদিকে ব্রাহ্ম সমাজ মনে করে, একটি মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজই প্রকৃত মুক্তির পথ। এই দ্বন্দ্বের ফলে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও মতানৈক্য দেখা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "গোরা" উপন্যাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার পাশাপাশি সার্বজনীন মানবতার ধারণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। গোরা চরিত্রের মধ্যে যেমন প্রথমে একটি সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা দেখা যায়, তেমনি উপন্যাসের শেষে তার মানসিক পরিবর্তন ঘটে এবং সে একটি সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।

গোরা যখন জানতে পারে যে সে আসলে একজন খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান, তখন তার ভেতরে যে মানসিক বিপর্যয় ঘটে, তা তাকে বুঝতে শেখায় যে প্রকৃত স্বাধীনতা এবং মুক্তি কেবল ধর্মের ভিত্তিতে অর্জন করা সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি গোরা'র মধ্যে এক ধরনের আত্মজিজ্ঞাসা এবং পরিণামে একটি উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটায়।

রবীন্দ্রনাথ "গোরা" উপন্যাসের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন যে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে হলে কেবল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নয়, বরং সমাজের সব শ্রেণি, ধর্ম এবং লিঙ্গের মানুষের মধ্যে এক ধরনের মানবিক ঐক্য তৈরি করতে হবে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ যদি কেবলমাত্র ধর্মীয় ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়, তবে তা কখনই সর্বজনীন হতে পারবে না এবং প্রকৃত অর্থে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হবে না। তাই, লেখক একটি বৃহত্তর, মানবিক জাতীয়তাবাদের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ধর্ম, জাত, এবং সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলবে।

"গোরা" উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার যে বহুমাত্রিক প্রকাশ দেখিয়েছেন, তা ভারতের ঔপনিবেশিক সময়ের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার একটি জটিল ছবি তুলে ধরে। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ভেতর দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা কেবলমাত্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন একটি সার্বজনীন মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরা'র মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, কীভাবে সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের প্রতি মানবিকতার মাধ্যমে একটি প্রকৃত ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা গড়ে তোলা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ভারতীয় সমাজের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের একটি গভীর প্রতিচ্ছবি।


রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে 'গোরা' উপন্যাসের সার্থকতা বহুমাত্রিক। এটি শুধু একটি গল্প নয়, বরং একটি সময়ের দলিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদ, ধর্ম, সমাজ সংস্কার, এবং ব্যক্তিসত্তার দ্বন্দ্বকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একীভূত করেছেন। গোরা উপন্যাসের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতির বহুমুখী সমস্যাগুলোর উপর আলোকপাত করেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি যুগান্তকারী সৃষ্টি, যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অনন্য মিশ্রণ পাওয়া যায়। উপন্যাসের মূল চরিত্র গোরা, তার রাজনৈতিক দর্শন এবং ব্যক্তিগত জীবনসংগ্রাম—এই দুইয়ের টানাপোড়েনে এক জটিল মানসিক ও আত্মিক অভিযাত্রার মধ্যে দিয়ে যায়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা এবং দেশপ্রেমের উত্তরণ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের জটিলতাও উপন্যাসটির বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গোরা নিজেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে দেখতে চায়, কিন্তু উপন্যাসের শেষে তার আত্মদর্শন এবং পরিচয়ের প্রশ্ন তাকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে উপন্যাসটি রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তন ও মানবিকতার স্বীকৃতির দিকটি তুলে ধরে। তাই, গোরা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক উপন্যাস নয়, এটি মানুষের আত্মিক ও নৈতিক মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিকভাবে, এই উপন্যাসটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে ব্যক্তির মানবিক মূল্যবোধের সংঘাত এবং তার উত্তরণের চিত্রায়ণে এক অতুলনীয় রচনা।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url