কালীগঞ্জ থেকে বালিয়াকান্দি - আসিফ করিম শিমুল

২৪ জানুয়ারি, ২০১৯ তারিখে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর সুপারিশপত্র হাতে পেলাম। আমাকে নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার ‘বালিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজে’ নিয়োগ সুপারিশ করা হয়েছে। নিয়োগ সুপারিশ হাতে পেয়ে জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো স্বস্তির নিশ্বাসস ফেললাম।



কলেজে কীভাবে যোগাযোগ করবো এটা নিয়ে আরেক দ্বিধায় পড়লাম। গুগোলে বালিয়াকান্দি কলেজ লিখলে রাজবাড়ির বালিয়াকান্দি কলেজ দেখায়। ঊগওঝ ওয়েবসাইট থেকে যে স্কুল-কলেজের তথ্য পাওয়া যায় সেটা তখনও জানি না। বাধ্য হয়ে সরাসরি কলেজে গিয়ে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।


সুলতান মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ


০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে কালীগঞ্জ বাজার থেকে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে মামুন পরিবহনে উঠলাম। অপরিচিত জায়গাতে যাচ্ছি, মনের ভেতর এক ধরনের ভয় কাজ করছে, বুক ধক ধক করছে- কি জানি কী হয়। আমার পাশের সিটে লক্ষ্মীপুরের এক যাত্রী পেলাম। আলাপ হলো তার সঙ্গে- পেশায় পুলিশ এবং পোস্টিং আমাদের কালীগঞ্জেই। আমার নোয়াখালী যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বললাম তাকে। লোকটি আমাকে আশ^স্ত করলো যথাস্থানে নামাতে সাহায্য করবে। পুলিশের চরিত্র নিয়ে মনের ভেতর একটা শঙ্কা ছিলো। লোকটিকে সব বললাম ঠিকই- কিন্তু তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিনা।

ঢাকা সায়েদাবাদ এসে গাড়ির সুপারভাইজার জানালো গাড়ি আর নোয়াখালীর দিকে যাবেনা। কারণ নোয়াখালীর যাত্রী আছে মাত্র দুই জন। বাকিরা ঢাকা আসতে আসতেই নেমে গেছে। সুপারভাইজার আমাদের দুজনের ঢাকার ভাড়া রেখে বাকি টাকাগুলো ফেরত দিলো। সময় তখন ভোর ৪ টার একটু বেশি। সায়েদাবাদ এসে দিক হারিয়ে ফেলেছি। পূর্ব-পশ্চিম চিনতে পারছিনা। পুলিশ ভাইটা তখনও আমাকে আগলে রেখেছেন এবং আমার অসহায় ভাব দেখে বার বার আশ^স্ত করছেন- চিন্তার কিছু নেই, ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন। পুলিশ ভাই আমাকে নিয়ে এলেন জোনাকী কাউন্টারে। গাড়ি ছাড়বে ভোর ৫ টায়। হাতে কিছুটা সময় আছে। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে আনা কিছু খাবার খেয়ে চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকলাম। সকাল ১০ টার দিকে গাড়ি চৌরাস্তা পৌঁছালে পুলিশ ভাই আমাকে বললেন, ‘আপনি এখানে নেমে যান। এখান থেকে সেনবাগের সিএনজি পাওয়া যাবে। সেনবাগ পৌঁছে যেকোনো রিক্সাওয়ালাকে বললে আপনার বালিয়াকান্দি কলেজে নামিয়ে দিবে।’

গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আগে তো সাথে একজন ছিলো, মনে কিছুটা সাহস পাচ্ছিলাম। এখন পুরোপুরি একা। সিএনজিওয়ালা, রিক্সাওয়ালাদের সাথে কথা বলতে যেয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। ওরা কী বলছে তার সত্তর ভাগই বুঝতে পারছিনা। কথা শুনে মনে হচ্ছে কানের কাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। অবশেষে এক সিএনজিওয়ালার কথায় বুঝলাম সে কলেজ চেনে। একটু আশ^স্ত হলাম। সিএনজিতে উঠে বসলাম। কিছুক্ষণ পর সিএনজিওয়ালা আমাকে নামিয়ে দিয়ে বললো, কলেজে চলে এসেছি। তার ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে পেছন ফিরে দেখি বেশ জাকজমকপূর্ণ একটি কলেজ, বড়সড় গেট এবং গেটে নাম লেখা ‘লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক মহিলা কলেজ।’

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। যাবো কোন কলেজে আর এলাম কোন কলেজে। কলেজের সামনের দোকানদারদের সাথে কথা বললাম। ওরা কী বলে কিছুই বুঝিনা। সবাই বলছে শ্রমোনশি যান। আমি বুঝতে পারছিনা কলেজে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে সবাই শ্রমোনশি কেন বলছে? ততক্ষণে আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। অপরিচিত জায়গায় এসে হারিয়ে গেলাম না তো? নিজের অজান্তেই ধপ করে বসে পড়লাম দোকানের বেঞ্চে। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেছে ঠাই বসে আছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এলেন দোকানে সিগারেট কিনতে। ভদ্রলোককে দেখে দোকানদার যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হলেন। উনারা কি কথাবার্তা বললেন বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক সিগারেট শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলুন আমি আপনাকে কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি। আমার বাড়ি বালিয়াকান্দি। আমি আপনার কলেজের পেছন দিয়েই যাবো।’ বাস থেকে নামার পর এই প্রথম একজনের মুখের ভাষা পূর্ণাঙ্গ বুঝতে পারলাম কিন্তু মন থেকে সন্দেহ গেলো না- যদি অন্য কোথাও নামিয়ে দেয় কিংবা দূরে কোথাও নিয়ে টাকাপয়সা মোবাইল সব ছিনিয়ে নেয় তখন কী হবে?

বুকের ভেতর থেকে ডুকরে ডুকরে কান্না পেতে লাগলো। কিন্তু এই মুহূর্তে লোকটিকে বিশ^াস না করে উপায়ও নেই। শেষমেষ নিজেকে শক্ত করে লোকটির সাথে চলা শুরু করলাম। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই সিএনজি থামলো। লোকটি বললো শ্রমোনশি যাবো। আবারও শ্রমোনশি শব্দটা শুনলাম। মনে মনে বুঝলাম এটা একটা জায়গার নাম হবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে স্টেশনে থামলো। আমরা নেমে গেলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও শ্রমোনশি লেখা নেই। সবখানে লেখা ছমিরমুন্সির হাট।
রাস্তা পার হতে হতে লোকটি বললেন, আসেন এবার বকশিরহাটের সিএনজিতে উঠতে হবে। আমি বললাম, বালিয়াকান্দির গাড়ি কোথায়? লোকটি হেসে ফেললেন। বললেন, এই গাড়িতেই বালিয়াকান্দি কলেজ যেতে পারবেন। যাইহোক, মনে সন্দেহ-সংশয় যাই থাকুক লোকটির সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি ছাড়লো। রাস্তার যে করুণ দশা, একেক ঝাকিতে কলিজা পর্যন্ত কেঁপে যায়। প্রায় ৩০ মিনিট পর বিবিএম নামক একটি ইট ভাটার সামনে এসে পৌঁছালাম। লোকটি গাড়ির মধ্য থেকেই বললেন, এই রাস্তা ধরে চার পাঁচ মিনিট হাটলেই ডান হাতে আপনার কলেজ দেখতে পাবেন। লোকটিকে ধন্যবাদ দিয়ে সিএনজি থেকে নেমে হাটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সত্যি সত্যিই একটি কলেজে এসে পৌঁছালাম। কলেজের নাম ‘সুলতান মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ।’

কলেজের নাম দেখে মনে হলো বুকের ভেতর কে যেন একশো মন ওজনের হাতুড়ির আঘাত করলো। হায়! হায়! আবারও ধোকা খেলাম? কোথায় সেই বালিয়াকান্দি কলেজ? আর কখন সেখানে পৌঁছাবো? দুপুর ১২টা পার হয়ে গেছে ততক্ষণে। অফিস টাইমে পৌঁছাতে না পারলে যোগাযোগ করবো কীভাবে? থাকবো কোথায়? নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। মনে মনে ভেবেই নিলাম, আমার ভাগ্যে বালিয়াকান্দি কলেজে যোগদান করা বোধহয় আর হলো না। যাইহোক সামনে এগোতে লাগলাম।

ফেব্রুয়ারি মাস- শীতের শেষে ফাল্গুনের হাওয়া বইছে। তখনও কুসুম কুসুম শীত রয়েছে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখি বর্তমান লাইব্রেরির সামনে মাঠের ভেতরে চেয়ারে পাঞ্জাবী টুপি পরা এক ভদ্রলোক বসে আছেন (পরে জানতে পারি উনি আমাদের মহসীন স্যার)। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার এখান থেকে বালিয়াকান্দি কলেজ কতদূর?

নিভৃত বাংলার আপডেট পেতে Google News এ Follow করুন

-এটাই বালিয়াকান্দি কলেজ।
-তাহলে প্রবেশপথে যে নাম দেখলাম সুলতান মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ?
-হ্যাঁ, আগে বালিয়াকান্দি কলেজ নাম ছিলো, এবছর থেকে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু আপনি কে?
-স্যার আমার নাম মো. আসিফ করিম। আমি বালিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজে নিয়োগ সুপারিশ পেয়ে সুদূর ঝিনাইদহ জেলা থেকে এখানে এসেছি।
-ওহ আচ্ছা! আপনিই তাহলে নতুন বাংলার স্যার? অভিনন্দন! অভিনন্দন!
মহসীন স্যার উঠে দাঁড়িয়ে আমার সাথে করমর্দন করলেন এবং আমাকে অফিস রুম দেখিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরে শুষ্ক দেহে প্রাণ ফিরে পেলাম।

প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে বসে আছি। স্যার খুব আন্তরিকতার সাথে আমার খোঁজ খবর নিলেন। আমার জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করালেন। সৌজন্যতা শেষে আমার কাছে কাগজপত্র চাইলেন। সব কাগজপত্র সেটিং করেই এনেছিলাম। ফাইল ধরে স্যারকে দেখালাম। স্যার একটা একটা করে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলেন এবং বললেন, ‘এগুলি আপনি জমা দিয়ে যান। এর উপর ভিত্তি করে আমরা জিবি মিটিং করে নির্ধারিত সময়ে আপনাকে ডাকবো।’

অফিসিয়াল কাজ একপ্রকার শেষ হলো। আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে বললাম, স্যার এবার এলে তো আমাকে একবারে থাকার জন্যই আসতে হবে। কিন্তু এখানে তো পরিচিত কেউ নেই কিংবা বাসা বা মেস নিতে গেলেও তো দুএকদিন সময় লাগবে। সে দুএকদিন থাকার যদি কোনো ব্যবস্থা থাকতো...

আমার কথা শেষ না হতেই স্যার এক পিওনকে দিয়ে অন্য এক স্যারকে ডাকালেন। যিনি এলেন দেখতে একটু খাটো, বেশ মোটা সোটা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জাদরেলি গোঁফ, ব্লেজার আর জিন্স পরা, চেহারায় রাজকীয় ভাব- দেখেই ভয় ভয় করতে লাগলো। প্রিন্সিপাল স্যার উনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন-
-ইনি আক্তারুজ্জামান। ইতিহাসের প্রভাষক। কলেজের পাশেই একটা বাসা নিয়ে ব্যাচেলর থাকেন। আপনি এসে ইনার কাছে উঠবেন এবং প্রয়োজনে ইনার সহযোগীতা নিয়ে নতুন বাসা খুঁজে নিবেন।

আক্তার স্যারকে প্রথম দেখে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু কথা বলে ভয়টা একেবারে দূর হয়ে গেলো। যেমন আন্তরিক তেমনি হাস্যরসিক। মুহূর্তেই যেন খুব আপন হয়ে গেলাম। মনেই হলো না ইনি আমার কলিগ। তার কাছে যেন বড় ভাইয়ের স্নেহের পরশ পেলাম।

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বৃহস্পতি বার। কালীগঞ্জ বাজারে গিয়েছি কী একটা কাজে। সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই জানালো, ‘আমি বালিয়াকান্দি কলেজ থেকে বলছি। আপনার নিয়োগপত্র রেডি হয়েছে। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি যোগদানপত্র সাবমিট করে কলেজে যোগদান করবেন।’ ঐদিন কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম।
২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ শুক্রবার। সকাল থেকেই বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব। আত্মীয়-স্বজন খবর পেয়ে কেউ কেউ আমাকে বিদায় জানাতে আসছেন। আম্মা সেসব আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলতে বলতে কখনও হাসছেন, কখনও কাঁদছেন। নানা পদের রান্নার আয়োজন হচ্ছে- যেন শেষ বিদায় নিতে চলেছি। বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকালে বাড়ি থেকে বের হলাম। সন্ধ্যা ৭ টায় কালীগঞ্জ বাজার থেকে গাড়ি ছাড়লো।

আজ ফেরিঘাটে জ্যাম কম। ঢাকার মধ্যেও তেমন কোনো ঝামেলা হলো না। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে কলেজে এসে উপস্থিত হলাম। তখনও কলেজ খোলেনি। ব্যাগে বাড়ি থেকে আনা কিছু রুটি অবশিষ্ট ছিলো। কয়েকটি রুটি গেটের সামনে সিড়িতে বসে খেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কলেজ খোলার।

যথাসময়ে কলেজ খুললো। প্রিন্সিপাল স্যার এলেন। নিয়োগপত্র হাতে পেলাম। যোগদানপত্র জমা দিলাম। ভাইস প্রিন্সিপাল নূর উদ্দীন ভূঁইয়া স্যার কলেজের পাঞ্চ মেশিনে আমার ফিঙ্গার প্রিন্ট রেজিস্টার্ড করে দিলেন। ব্যাস আমার যোগদান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। প্রিন্সিপাল স্যার এবং ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার তাৎক্ষণিক ১০ মিনিটের জরুরী বৈঠক ডেকে সব শিক্ষক কর্মচারীর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি ঐদিন দুইটা ক্লাস নিলাম।

কলেজে যোগদানের আনন্দে এতক্ষণ অন্যকিছু খেয়ালে আসেনি। ছুটির আগমুহূর্তে মনে হলো যার কাছে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল সেই আক্তার স্যারই তো নেই। তাহলে কী হবে? শুক্রবার গাড়িতে উঠে আক্তার স্যারকে জানিয়েছিলাম আমি আসছি। স্যার বলেছিলেন তিনি বাড়িতে আছেন, নির্ধারিত সময়ে চলে আসবেন। আবার স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার জানালেন একটা সমস্যায় পড়েছেন আসতে সন্ধ্যা ৬ টা বাজবে। সে পর্যন্ত একটু কষ্ট করে নিজেকে ম্যানেজ করতে হবে। প্রিন্সিপাল স্যারকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন, ‘আপনার ব্যাগটা কলেজে রেখে যান আর নাইটগার্ডের ফোন নাম্বার নিয়ে যান। মাগরিবের সময় নাইটগার্ড থাকবে কলেজে, তখন ব্যাগ নিয়ে নিবেন।’ আর কী করা- খাবারের পলিথিনটা বের করে কলেজে ব্যাগ রেখে দিলাম আর নাইটগার্ড ফারুক ভাইয়ের ফোন নাম্বার নিয়ে নিলাম।

কলেজ ছুটি হলো দুপুর ২ টায়। আক্তার স্যার আসবে সন্ধ্যা ৬ টায়। হাতে এখনও চার ঘন্টা সময়। কী করবো এই চার ঘন্টা? ক্ষুধাও লেগেছে কিছুটা। হাতের পলিথিনে বাড়ি থেকে আনা রুটি আছে কয়েকটা কিন্তু ভাজি শেষ হয়ে গেছে সকালেই। কোনো দোকানে কলা পাওয়া গেলে কলা দিয়ে রুটি খাওয়া যাবে। কলার সন্ধানে হাটতে হাটতে বকশিরহাট বাজারে এলাম। এক মুরুব্বি দোকানদারকে বললাম, কলা দেন।
-কওগা?
-কলা দেন।
-কওগা?
আমি যতবার বলি কলা দেন, মুরুব্বি ততবার বলে কওগা। বুঝলাম না কলা চাইছি আর উনি কওগা কওগা করছেন কেন (অনেক পরে জানতে পারি কওগা শব্দের অর্থ কতটা)? নিজেই দুইটা কলা ছিড়ে মুরুব্বিকে ২০ টাকার নোট দিলাম, মুরুব্বি আমাকে ১০ টাকা ফেরত দিলেন। রুটি কলা খেয়ে শরীরে বেশ একটু জোশ পেলাম।

কলেজে যতক্ষণ ছিলাম কীভাবে সময় কেটেছে টের পাইনি। এখন যেন ঘড়ির কাটা থমকে গেছে। এ দোকানে বসি, ও দোকানে বসি সময়ই আর কাটে না। কী করা যায়? বকশিরহাট থেকে উত্তর দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে একসময় ছমিরমুন্সির হাটে পৌঁছে গেলাম। হাতে এখনও অনেক সময়। এক সিএনজিতে উঠলাম, কোথায় যাবো জানিনা। চৌমুহনী পৌঁছে সিএনজি আর গেলো না। নেমে পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হাটতে হাটতে চৌরাস্তায় চলে এলাম যেখানে সকালেই বাস থেকে নেমেছি। দীর্ঘ সময় হেঁটে বেশ ক্লান্ত লাগছে। এক হোটেলে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছু নাস্তা করলাম। আবার হাটতে হাটতে চৌমুহনী এলাম। সিএনজি করে ছমিরমুন্সির হাটে পৌঁছে দেখি বিকাল প্রায় সাড়ে ৫ টা বেজে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আর ছয়টার মধ্যে কলেজে পৌঁছাতে হবে। সুতরাং আর হাঁটা যাবে না। সিএনজিতেই যেতে হবে। ছয়টার মধ্যে কলেজে ফিরলাম। দেখি শুনশান নিরবতা। না আছে আক্তার স্যার আর না আছে ফারুক ভাই। শুধু কানে শাঁ শাঁ আওয়াজ আসছে। উপরে তাকিয়ে দেখি লক্ষাধিক মশা আমার মাথার উপরে শাঁ শাঁ করে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ভর দুপুরে বের হয়েছিলাম বলে শীতের কাপড় ব্যাগে রেখে গেছিলাম। এখন একটু শীত শীত লাগছে। ব্যাগ তো কলেজের ভেতরে। ফারুক ভাই না এলে ব্যাগ নেওয়ার উপায় নেই। ফারুক ভাইকে ফোন দিলাম। জানালেন কী একটা জরুরী কাজে ছমিরমুন্সি গেছেন। আসতে এক ঘন্টা লেগে যাবে। আক্তার স্যারকে ফোন দিলাম। নাম্বার বন্ধ। টেনশন শুরু হয়ে গেলো। এখন কী করবো? টেনশনে শীতভাব কেটে শরীরে ঘাম ছুটতে লাগলো। এদিকে সেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ফোনে চার্জ করে আনা। ২৪ ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। ফোনের চার্জও সীমিত। ফারুক ভাই না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। ফোন দেখলে একটু সময় কাটতো। চার্জ শেষ হওয়ার ভয়ে ফোনও টিপতে পারছি না।

একদিকে শীত, অন্যদিকে মশা। একটু স্থির হলেই মশা যেন জাল বিছিয়ে আক্রমণ করছে। শীত আর মশার হাত থেকে বাঁচার দারুণ একটা উপায় পেয়ে গেলাম। কলেজের পুরো মাঠ জুড়ে আর্মিদের মতো লেফট রাইট করে বেড়াতে লাগলাম।

সন্ধ্যা ৭ টা ১০ মিনিটের দিকে আক্তার স্যারকে আবার ফোন দিলাম। আহ শান্তি! ফোনে কল যাচ্ছে। স্যার রিসিভ করলেন- জানালেন পারিবারিক কী একটা ঝামেলায় আটকে গেছেন। আজ আর নোয়াখালী আসবেন না। প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে ফোনে ছুটি নিয়েছেন। রবিবার সকালে পৌঁছে একবারে কলেজ করবেন।
-তাহলে আমি এখন কী করবো? কোথায় থাকবো?
-চিন্তার কিছু নেই। আমার রুমমেটকে আপনার নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। উনি এসে আপনাকে রিসিভ করবেন।

দুই মিনিটের মধ্যেই একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো। রিসিভ করে সালাম দিলাম। আক্তার স্যারের রুমমেট ফোন দিয়েছেন। নাম বিল্লাল। গ্রামীন ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি জানালেন এখন তার অফিসে ডে ক্লোজিং চলছে। শেষ হতে আধাঘন্টা মতো লাগবে।

ফারুক ভাইকে আবার ফোন দিলাম। রিং হয়, রিসিভ করেন না। পাঁচ ছয় বার কল করার পর আমার ফোন জানালো লো-ব্যাটারি। বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। একটা ইটের টুকুরো ম্যানেজ করে লাইব্রেরির ওই ভবনের মেঝেতে আক্তার স্যার, বিল্লাল ভাই আর ফারুক ভাইয়ের নাম্বারটা লিখে রাখলাম। আবার শুরু করলাম লেফট রাইট।

কয়টা বাজে, কত সময় পার হলো এগুলো দেখার টাইম নেই এখন। সমানে লেফট রাইট করে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। সম্বিত ফিরলে বুঝলাম পকেটে ফোন বাজছে। ফোন তুলে দেখি রাত সাড়ে আটটা বাজে। বিল্লাল ভাই ফোন দিয়েছেন। অর্থাৎ আধাঘন্টার কথা বলে প্রায় দেড় ঘন্টা পর ফোন। যাইহোক, তিনি জানালেন, কলেজের দিকে রওনা দিয়েছেন। আসতে দশ মিনিট লাগবে।

আড়াই ঘন্টা ধরে লেফট রাইট করতে করতে আমি ক্লান্ত। হাত নেড়ে মশা মারবারও আর শক্তি নেই। লাইব্রেরি ভবনের মেঝেতে যেখানে নাম্বার লিখেছিলাম তার পাশে বসে পড়লাম। দশ বারো মিনিট পর পকেটে আবার ফোন বাজলো। বের করে দেখি বিল্লাল ভাই ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করার আগেই ফোন অফ হয়ে গেলো। হাত ত্রিশেক সামনে একজনের হাতে মোবাইলে আলো জ¦লছে। বুঝলাম উনিই বিল্লাল ভাই। গলা ছেড়ে ডাক দিলাম। উনি এসে দেরি হওয়ার জন্য অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। সারাদিনের ঘটনা তাকে খুলে বললাম।

বিল্লাল ভাইকে পেয়েছি, এখন ব্যাগ নিতে পারলেই রুমে ফিরতে পারবো। বিল্লাল ভাইকে বললাম, ফ্লাশ লাইট জে¦লে নাম্বারটা তুলে ফারুক ভাইকে ফোন দিতে। ফারুক ভাই ফোন ধরলেন, বললেন আর কিছুক্ষণ লাগবে আসতে। দুজন বসে মশার কামড়ের সাথে গল্প করতে লাগলাম। এর মাঝে কিছুক্ষণ পর পর বিল্লাল ভাই ফারুক ভাইকে কল দেন কিন্তু ফারুক ভাই কল রিসিভ করেন না। আরও দুই ঘন্টা পর, অর্থাৎ রাত যখন সাড়ে দশটা বাজে তখন এলেন ফারুক ভাই। বিল্লাল ভাই তো রেগে আগুন হয়ে আছেন ফারুক ভাইকে পুড়িয়ে মারার জন্য। কিন্তু ফারুক ভাই যে বিপদের কথা শোনালেন তাতে আর কেউই কিছু বলতে পারলাম না। ফারুক ভাই তালা খুলে দিলে ব্যাগ নিয়ে বিল্লাল ভাইয়ের সাথে রুমের দিকে রওনা দিলাম। রুমে যখন পৌঁছলাম তখন সময় রাত এগারোটা। কিন্তু ততক্ষণে আমার শরীরের বারোটা বেজে গেছে।

আসিফ করিম শিমুল
প্রভাষক (বাংলা)
সুলতান মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ
বিজবাগ, সেনবাগ, নোয়াখালী।


Next Post Previous Post
5 Comments
  • Anonymous
    Anonymous September 4, 2024 at 11:45 PM

    🫶🌸

  • মহুয়া আক্তার
    মহুয়া আক্তার September 5, 2024 at 1:08 AM

    মজা পাইছি

  • Nupur Biswas
    Nupur Biswas September 5, 2024 at 10:49 AM

    Sir, apnar dhoirjo ace bolte hoi.

  • টুম্পা সরকার
    টুম্পা সরকার September 5, 2024 at 10:57 AM

    ওয়াও!! মনে হলো এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম।

  • মুনমুন
    মুনমুন September 5, 2024 at 2:40 PM

    অনেক সুন্দর

Add Comment
comment url