বাংলা গদ্যের সার্থক স্রষ্টা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) বাংলা গদ্যের উন্নতি ও শুদ্ধিকরণে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব শুধু বাংলা ভাষার গদ্যের কাঠামো গঠনে নয়, বরং ভাষার মধ্যে সাহিত্যিক রুচি, সমাজ সংস্কার ও আধুনিক চিন্তাধারার প্রতিফলনে। তাঁর ভাষা গঠন, সংস্কৃতি ও সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা গদ্যের রূপান্তরের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন করে। বিদ্যাসাগরের বাংলা গদ্যের উৎকর্ষে অবদানের বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা:

বিদ্যাসাগরের শৈশব ও শিক্ষাজীবনের সঙ্গে তাঁর ভাষার প্রতি মমত্ববোধ ও সংস্কারক মনোভাব গভীরভাবে জড়িত। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর পিতা, ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ছিলেন একজন নিরক্ষর মানুষ, কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষার প্রতি অদম্য আগ্রহ দেখান। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাঠাভ্যাসে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী সময়ে সংস্কৃত কলেজে পড়ার জন্য কলকাতায় আসেন। এই সময়ে তিনি বাংলা, ইংরেজি, এবং সংস্কৃত ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন, যা তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

গদ্যের প্রারম্ভিক ইতিহাস ও বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী অবস্থা:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বিশ্লেষণ করতে হলে বাংলা গদ্যের প্রারম্ভিক ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম রূপ সাধু ও চতুষ্পদী ছন্দে লেখা ছিল, যা মূলত ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী পরিবেশন করত। মধ্যযুগীয় বাংলা গদ্য ছিল কাব্যনির্ভর এবং সাধারণত এতে সুনির্দিষ্ট গদ্যরীতি ছিল না। এসময় গদ্য স্রষ্টার চেয়ে কবিরাই বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তবে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আধুনিকতার ছোঁয়া বাংলা ভাষার ওপর পড়তে শুরু করে, এবং এক নতুন ধরনের গদ্যের প্রয়োজন অনুভূত হয়।

বিদ্যাসাগরের গদ্য ভাষার নির্মাণশৈলী:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলায় এক সুস্পষ্ট ও প্রাঞ্জল গদ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখা গদ্য সহজবোধ্য, পরিষ্কার এবং বক্তব্যপ্রধান ছিল। তিনি ভাষাকে দৃষ্টিনন্দন করতে অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কার বা কঠিন শব্দের ব্যবহারে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর গদ্য ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে সহজে বোধগম্য ছিল, যা গদ্যের মৌলিক উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হয়েছিল।

সাধু ভাষার প্রবর্তন:

বিদ্যাসাগরের প্রধান অবদানগুলোর মধ্যে একটি ছিল সাধু ভাষার প্রতিষ্ঠা। এই ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণের ভিত্তিতে গঠিত, কিন্তু এতে শব্দের সরলতা এবং স্পষ্টতা ছিল। তাঁর আগে বাংলা ভাষায় লিখিত গদ্য তেমন প্রচলিত ছিল না। কিন্তু তিনি একটি সুনির্দিষ্ট ভাষা কাঠামো দাঁড় করান যা পরবর্তী সাহিত্যিকদের জন্য একটি ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যাসাগর একদিকে সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার জ্ঞানকে ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় গদ্যের মৌলিক রূপায়ণে নিযুক্ত হন।

নতুন রীতির প্রবর্তন:

বিদ্যাসাগর গদ্যের মধ্যে একটি নতুন ধরনের রীতি প্রবর্তন করেন, যেখানে বাক্যের গঠন সহজ ও সুনির্দিষ্ট ছিল। তিনি ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করতেন, যা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের লম্বা ও জটিল বাক্যবিন্যাসের থেকে ভিন্ন। তাঁর এই শৈলী ছিল অধিকতর প্রাসঙ্গিক ও ব্যবহারিক। তিনি গদ্যকে বর্ণনামূলক না রেখে বক্তৃতামূলক শৈলীতে লিখতেন, যা বক্তব্যকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে সহায়ক ছিল।

গদ্যে সমাজ সংস্কার ও নৈতিক শিক্ষা:

বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারকও। তাঁর রচনায় সমাজের অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি সুস্পষ্ট মনোযোগ ছিল, বিশেষত নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ এবং কুসংস্কার দূরীকরণের ক্ষেত্রে। তাঁর গদ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রতি সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেখা যায়।

 ‘বর্ণপরিচয়’ এবং শিক্ষাবিদ্যা:

বিদ্যাসাগরের রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে যুগান্তকারী অবদান রেখেছে। এই বইয়ের মাধ্যমে তিনি শিশুদের সহজে বাংলা শেখার পথ সুগম করেন। ‘বর্ণপরিচয়’ বাংলা ভাষার শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়, এবং এটি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এর সহজ গদ্যশৈলী এবং কার্যকর পদ্ধতির কারণে শিশুদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

বিধবা বিবাহ প্রচলন:

বিদ্যাসাগরের আরেকটি বিখ্যাত রচনা হলো ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’ নামে একটি প্রবন্ধ। এই রচনার মাধ্যমে তিনি সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং বিধবার প্রতি সমাজের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর তোলেন। তিনি নারী স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, যা তাঁর গদ্যরচনায় একটি সুস্পষ্ট বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থিত ছিল। তাঁর গদ্যে নারী শিক্ষার গুরুত্ব এবং নারীদের সামাজিক অবস্থান উন্নত করার প্রয়াস বিদ্যমান ছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাসমূহ ও সাহিত্যিক প্রভাব:

বিদ্যাসাগরের উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে আছে ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’, ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’, এবং ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা’। তাঁর অনুবাদ, মৌলিক রচনা এবং প্রবন্ধ সাহিত্যিক চিন্তার জগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তাঁর লেখা প্রতিটি রচনাই ছিল সময়োপযোগী এবং সমাজের প্রতি একটি বার্তা বহনকারী।

 ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’:

‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ছিল বিদ্যাসাগরের একটি বিখ্যাত অনুবাদ কর্ম। এটি মূলত সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছিল। অনুবাদক হিসেবে বিদ্যাসাগর ছিলেন অতুলনীয়। তিনি অনুবাদের সময় মূল কাহিনির মর্মার্থ অক্ষুন্ন রেখে তা বাংলায় রূপান্তর করতেন, যা সমকালীন পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তাঁর এই কাজ বাংলায় অনুবাদ সাহিত্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 ‘সীতার বনবাস’ ও মহাকাব্যিক রচনা:

‘সীতার বনবাস’ বিদ্যাসাগরের অন্যতম আলোচিত রচনা, যা মূলত রামায়ণ কাহিনির উপর ভিত্তি করে রচিত। এতে বিদ্যাসাগর সীতার চরিত্রের মাধ্যমে নারীশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং একধরনের সামাজিক বার্তা দিয়েছেন।

বিদ্যাসাগরের গদ্য শৈলী ও উত্তরাধিকার:

বিদ্যাসাগরের গদ্য শৈলী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর গদ্যের সরলতা, স্পষ্টতা এবং সামাজিক প্রতিফলন ভবিষ্যতের লেখকদের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের অনেক সাহিত্যিক তাঁর শৈলী থেকে প্রভাবিত হয়েছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্য শৈলী বাংলা ভাষার জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যা ভাষার গঠনশৈলীতে যেমন প্রভাব ফেলেছে, তেমনি সাহিত্যিক ও সামাজিক দিক থেকে একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের সার্থক স্রষ্টা হিসেবে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। তিনি বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র একটি ভাষাগত মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বরং এই ভাষাকে ব্যবহার করে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে, সমাজের সংস্কারে এবং মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও বোধগম্যতার আলো ছড়াতে বিশাল অবদান রেখেছেন। বিদ্যাসাগরের সাহিত্যকর্ম, শিক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজসংস্কারের প্রয়াস তাঁকে বাংলা গদ্যের সার্থক স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এই দীর্ঘ আলোচনায় বিদ্যাসাগরের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম, গদ্যশৈলী, শিক্ষায় অবদান এবং সমাজ সংস্কারে ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, যা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের শৈশব ও শিক্ষাজীবনের উপর যদি আমরা একটু নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব যে তাঁর জীবনের প্রাথমিক পর্ব থেকেই শিক্ষার প্রতি এক অদম্য অনুরাগ ছিল। ১৮২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর পিতামাতা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষা ছিল অসাধারণ। অল্প বয়সেই তিনি সংস্কৃত, বাংলা, এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ, কবিতা, সাহিত্য এবং ন্যায়শাস্ত্রে অত্যন্ত পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সংস্কৃত ভাষার গভীর জ্ঞানই তাঁর গদ্যশৈলীর ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর লেখায় সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব লক্ষ করা যায়, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি বাংলা গদ্যকে এমনভাবে রূপান্তর করেন যাতে তা সহজবোধ্য এবং সরল হয়।

বিদ্যাসাগরের সময়ে বাংলা ভাষার গদ্যশৈলী সুসংহত এবং সুপরিকল্পিত ছিল না। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য মূলত কবিতা ও পদ্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হতো। বাংলা গদ্যের চর্চা তখনও প্রাথমিক স্তরে ছিল। সমাজে গদ্যের চেয়ে পদ্যই বেশি জনপ্রিয় ছিল এবং শিক্ষিত মহলেও গদ্য তেমনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিদ্যাসাগর এই পরিস্থিতিকে পাল্টানোর উদ্যোগ নেন এবং বাংলা ভাষাকে একটি সুশৃঙ্খল এবং প্রাঞ্জল গদ্যশৈলীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন।

বিদ্যাসাগরের আগমনের আগে বাংলা গদ্য প্রচলিত ছিল না বললেই চলে। প্রাচীনকালে বাংলা গদ্য মূলত ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা হত, যেখানে শব্দের সরলতা এবং প্রাঞ্জলতার অভাব ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরনের গদ্য ভাষার কোনও ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। বিদ্যাসাগর এই সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে বাংলা গদ্যকে একটি সুশৃঙ্খল ভাষারূপে গড়ে তোলেন, যা পরবর্তী কালে সমাজের প্রতিটি স্তরে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যতম বড় অবদান ছিল বাংলা গদ্যে সাধু ভাষার প্রবর্তন। তিনি ভাষায় বিশুদ্ধতা এবং স্পষ্টতা আনতে চেষ্টা করেন। সংস্কৃত ভাষার প্রভাব নিয়ে গঠিত সাধু ভাষায় তিনি তাঁর রচনাগুলো রচনা করতেন। এটি একটি ব্যাকরণসম্মত ভাষা, যা সংস্কৃতের তত্ত্বগত নিয়মাবলির দ্বারা গঠিত, তবে শব্দের বুনন এবং বাক্যের সরলতায় এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

বিদ্যাসাগরের গদ্যশৈলীর আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাঞ্জলতা এবং সরলতা। তিনি গদ্য রচনার ক্ষেত্রে কঠিন এবং দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভাষা হলো ভাব প্রকাশের মাধ্যম, আর তাই ভাষার সরলতা ও স্পষ্টতা আবশ্যক। বিদ্যাসাগরের লেখা গদ্য ছিল সহজবোধ্য, যাতে সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারে এবং গ্রহণ করতে পারে। এটি বাংলা গদ্যের এক নতুন রূপ, যা বিদ্যাসাগরের আগে তেমনভাবে দেখা যায়নি। তাঁর গদ্যরচনার শৈলী ছিল নির্ভেজাল এবং বাস্তবসম্মত, যা পাঠকের চিন্তা-চেতনায় সহজেই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হতো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রবন্ধ এবং রচনাগুলোতে শিক্ষামূলক ভাবনা এবং সমাজ সংস্কারের বার্তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর রচনাগুলোতে যেমন ভাষাগত উৎকর্ষ ছিল, তেমনি ছিল সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সমাজের উন্নতির প্রতি গভীর নিষ্ঠা।

বিদ্যাসাগরের রচনা, যেমন ‘বর্ণপরিচয়, ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা, এবং তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ ও অনুবাদ সাহিত্য বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং সমাজের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে তিনি সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং কুপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর তুলেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের রচনা কেবল সাহিত্যিক উন্নতিই করেনি, বরং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রেখেছে। তাঁর লেখায় সমাজের সমস্যা, বিশেষ করে নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ, কুসংস্কার এবং নারীদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল।

বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি সমাজের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন নারীরা শিক্ষিত হবে এবং সমাজে তাঁদের অধিকার সুনিশ্চিত হবে। তাঁর ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা এবং কুসংস্কার দূরীকরণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা ছিল প্রাঞ্জল এবং বক্তব্য সুস্পষ্ট, যা সমাজের রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং তাঁর বক্তব্য সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুবাদকর্মগুলো বাংলা গদ্যের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন। এর মধ্যে ‘শকুন্তলা ও ‘বেতালপঞ্চবিংশতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর অনুবাদকর্মে তিনি মূল কাহিনির ভাব ও বক্তব্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন, যা বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধ করে।শকুন্তলা কাব্যটির বাংলা অনুবাদ বিদ্যাসাগরের একটি বিখ্যাত কাজ, যা মূলত সংস্কৃত ভাষায় কালিদাস রচিত। তিনি এই অনুবাদে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে সংস্কৃতের উচ্চ ভাষাকে বাংলায় রূপান্তরিত করে সহজ ও সরল ভাষায় উপস্থাপন করেন। বেতালপঞ্চবিংশতি বিদ্যাসাগরের আরেকটি জনপ্রিয় অনুবাদ কর্ম। এটি একটি ক্লাসিক্যাল সাহিত্যকর্ম, যা সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল।

বাংলা ভাষার গঠনশৈলী এবং ব্যাকরণিক রীতিনীতির বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অতুলনীয়। বাংলা গদ্যকে শৃঙ্খলাবদ্ধ, সংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল করতে বিদ্যাসাগরের অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে যতিচিহ্ন বা বিরামচিহ্নের সুষ্ঠু ব্যবহার একটি বড় দিক। বিদ্যাসাগরের সময় বাংলা গদ্য ভাষায় যতিচিহ্নের ব্যবহার যথেষ্ট স্পষ্ট বা প্রচলিত ছিল না। তিনি এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বাংলা ভাষায় যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যাসাগরের যতিচিহ্ন প্রচলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা গদ্যকে সুসংবদ্ধ, বোধগম্য এবং সুশৃঙ্খল করা।

উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত পদ্য ও কাব্যনির্ভর। ফলে ভাষায় যতিচিহ্নের প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে অনুভূত হয়নি। পদ্য বা কবিতায় ছন্দের মাধ্যমে ভাবপ্রকাশ সম্ভব হলেও গদ্যের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা, স্পষ্টতা, এবং বোধগম্যতার জন্য যতিচিহ্নের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। বিদ্যাসাগরের আগমনের পূর্বে বাংলা ভাষার গদ্যে যতিচিহ্নের ব্যবহারে শৃঙ্খলা ছিল না। এজন্য পাঠকদের পক্ষে লেখার মূল ভাব বুঝতে সমস্যা হত এবং গদ্যরচনায় ধীরতা বা শৃঙ্খলার অভাব দেখা যেত। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে একটি দৃঢ় কাঠামোয় আনতে যতিচিহ্নের প্রয়োগকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন এবং এটি প্রতিষ্ঠার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম প্রবর্তন করেন।

যতিচিহ্নের প্রচলনে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা:

বিদ্যাসাগরের অন্যতম প্রধান অবদান হলো বাক্যের গঠন শুদ্ধ করা। বাংলা ভাষায় বাক্যের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার জন্য তিনি যতিচিহ্নের প্রয়োগ সুনির্দিষ্টভাবে করেন। আগে বাংলা গদ্যে একটানা বাক্য লিখে যাওয়া হত এবং যেখানে থামতে হবে বা বিরতি দিতে হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় যতিচিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে বাক্যের মধ্যে সুস্পষ্ট বিরতি প্রদানের নিয়ম তৈরি করেন, যা গদ্যের শৃঙ্খলা ও বোধগম্যতা বৃদ্ধিতে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। তাঁর প্রচলিত যতিচিহ্নগুলো যেমনকমা (,), দাঁড়ি (।), প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?), এবং উদ্ধরণ চিহ্ন (" ")এইসব চিহ্ন গদ্যরচনায় শৃঙ্খলা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে আসে।

কমার (,) ব্যবহার:

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে কমার প্রয়োগে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কমা ব্যবহার করে বাক্যে সাময়িক বিরতি দেওয়া হয়, যা বাক্যকে একটানা দীর্ঘ না করে একটি সুস্পষ্ট ও অর্থবোধক কাঠামো প্রদান করে। আগে বাংলা গদ্যে কমার ব্যবহার খুবই সীমিত ছিল এবং বাক্যের মাঝখানে বিরতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হত না। বিদ্যাসাগর তাঁর রচনায় কমার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার শুরু করেন এবং বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব তুলে ধরেন। এটি ভাষাকে আরও প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য করে তোলে।

দাঁড়ির (।) ব্যবহার:

দাঁড়ি বা পূর্ণচ্ছেদ বাংলা ভাষায় বাক্যের সমাপ্তি নির্দেশ করে। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে দাঁড়ির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করেন। তাঁর সময়ে দাঁড়ির ব্যবহার এতটা সুসংবদ্ধ ছিল না, ফলে এক বাক্যের শেষ এবং অন্য বাক্যের শুরু নির্ধারণ করা কঠিন হত। বিদ্যাসাগর গদ্যে দাঁড়ির প্রয়োগের মাধ্যমে বাক্যের সুষ্ঠু বিভাজন এবং সুনির্দিষ্ট অর্থপ্রকাশ নিশ্চিত করেন।

প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) এবং বিস্ময়বোধক চিহ্ন (!) এর ব্যবহার:

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এবং বিস্ময়বোধক চিহ্নের সঠিক প্রয়োগে ভূমিকা রাখেন। প্রশ্নবোধক চিহ্নের মাধ্যমে একটি বাক্যের প্রশ্নবোধক স্বর নিশ্চিত করা হয়, যা আগে বাংলা গদ্যে তেমন প্রচলিত ছিল না। বিদ্যাসাগর এই চিহ্নের সঠিক ব্যবহার শুরু করেন, যা পাঠকদের প্রশ্ন এবং বিবৃতি আলাদা করে বুঝতে সাহায্য করে। তেমনিভাবে বিস্ময়বোধক চিহ্নও গদ্যে আবেগ, বিস্ময়, এবং তাৎপর্য প্রকাশে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যাসাগর এই দুটি চিহ্নের সঠিক এবং কার্যকর ব্যবহার করে বাংলা গদ্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন।

উদ্ধরণ চিহ্নের (" ") ব্যবহার:

উদ্ধরণ চিহ্ন বা কোটেশন মার্কের সঠিক ব্যবহার বিদ্যাসাগরের রচনায় লক্ষ করা যায়। এটি মূলত কোন বিশেষ বক্তব্য বা সংলাপ উদ্ধৃত করতে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যাসাগর তাঁর রচনায় উদ্ধরণ চিহ্নের মাধ্যমে সংলাপ বা বিশেষ বক্তব্যকে পৃথকভাবে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করেন, যা আগে তেমন প্রচলিত ছিল না।

বিদ্যাসাগরের যতিচিহ্ন প্রচলনের কার্যকারিতা:

যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহার বাংলা গদ্যের শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করেছে। বিদ্যাসাগর যতিচিহ্নের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার করে গদ্যের কাঠামোকে সুসংবদ্ধ করেছেন, যা পাঠকের কাছে আরও সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। আগে গদ্য পাঠে যে ধরনের অসুবিধা হত, তা যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দূর হয়। পাঠক সহজেই একটি বাক্যের সমাপ্তি এবং পরবর্তী বাক্যের সূচনা বুঝতে পারে, এবং ভাষার সুস্থিরতা বজায় থাকে।

যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর ভাষার বোধগম্যতা বৃদ্ধি করেছেন। ভাষার শুদ্ধতা এবং স্পষ্টতা রক্ষার জন্য যতিচিহ্ন অপরিহার্য। কমা, দাঁড়ি, প্রশ্নবোধক এবং অন্যান্য যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহারের ফলে ভাষার ভাব প্রকাশে আর কোনো জটিলতা থাকে না। পাঠক সহজেই একটি বাক্যের ভাব এবং উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।

বিদ্যাসাগরের যতিচিহ্নের প্রচলন আধুনিক বাংলা গদ্যের ভিত্তি তৈরি করেছে। যতিচিহ্নের সঠিক ব্যবহারের কারণে গদ্য আরও প্রাঞ্জল, সুসংহত, এবং সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। তাঁর দেখানো পথ ধরেই পরবর্তী লেখকগণ বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের প্রয়োগ অব্যাহত রাখেন, যা আজও বাংলা ভাষার গদ্যশৈলীর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বাংলা ভাষা, শিক্ষা ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় ও যুগান্তকারী। তিনি বাংলা গদ্যের সার্থক স্রষ্টা হিসেবে ভাষাকে শৃঙ্খলিত, প্রাঞ্জল ও সরল করেছিলেন, যার ফলে সাধারণ মানুষ সহজে ভাষার ব্যবহার শিখতে পেরেছে। তাঁর লেখা 'বর্ণপরিচয়' শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যা শিশুদের মধ্যে ভাষার মৌলিক ধারণা গড়ে তোলে। তিনি বাংলা গদ্যে যতিচিহ্নের শৃঙ্খলিত ব্যবহার প্রচলন করেন, যা ভাষার স্বচ্ছতা ও বোধগম্যতা বৃদ্ধি করে। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়, যা নারী স্বাধীনতার পথে বড় পদক্ষেপ। তিনি নারী শিক্ষার প্রসারেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর অনুবাদকর্ম, বিশেষত সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ, বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। সমাজ সংস্কারক হিসেবে তিনি কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। বিদ্যাসাগরকে যথার্থই বাংলা ভাষার রেনেসাঁর পুরোধা বলা হয়, কারণ তাঁর চিন্তা, কাজ এবং সমাজের প্রতি অবদান আজও প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণাদায়ক।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url