রাজবন্দীর জবানবন্দি প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলামের দেশপ্রেম - আসিফ করিম শিমুল
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং সাংবাদিক যার সাহসী ও বিদ্রোহী মনোভাব তাঁর সাহিত্যকর্মে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। নজরুলের লেখার মূল শক্তি ছিলো দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা এবং নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাঁর রচনায় মানবতা, সাম্য, বিদ্রোহ ও দেশপ্রেমের গভীর ছাপ লক্ষণীয়। নজরুলের সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শোষণ-বিরোধী মনোভাব এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য অবিরাম আহ্বান। এই আহ্বান তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গান এবং অন্যান্য রচনায় বারবার ফুটে উঠেছে। নজরুলের দেশপ্রেমের অন্যতম প্রতিচ্ছবি হলো তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'। এটি মূলত ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখা। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করার লক্ষ্যে রচিত এই প্রবন্ধ নজরুলের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯২০-এর দশকের শুরুর দিকে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিলো উত্তাল। ভারত তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে, এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কঠোরভাবে দেশের শাসন পরিচালনা করছিলো। ভারতীয় জনগণের ওপর ব্রিটিশদের অত্যাচার, শোষণ, এবং নিপীড়ন ছিল তীব্র। এই শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ১৯২০ সালে। যদিও তা অহিংস আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত, ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই আন্দোলন ছিলো ব্রিটিশ শাসনের প্রতি এক শক্তিশালী প্রতিরোধ।
কাজী নজরুল ইসলাম তখন কলকাতায় বসবাস করছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত নজরুল সাংবাদিকতা ও সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ব্রিটিশদের প্রতি তাঁর ঘৃণা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু সম্পাদনা করতেন, যেখানে তিনি তাঁর বিদ্রোহী চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতেন। ধূমকেতু-র মাধ্যমে নজরুল জনগণকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি প্রচণ্ড সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন।
১৯২২ সালে নজরুল তাঁর বিদ্রোহী কবিতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকার তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারাবন্দী করে। তার ধূমকেতু পত্রিকার অনেক রচনা ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। এই অবস্থায় নজরুল তাঁর বন্দি অবস্থায় লিখেছিলেন বিখ্যাত প্রবন্ধ 'রাজবন্দীর জবানবন্দি', যা ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়।
প্রবন্ধটি মূলত নজরুলের কারাগারের অভিজ্ঞতা এবং তাঁর দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসার এক সাহসী স্বীকারোক্তি। এটি শুধু একটি প্রবন্ধ নয়, এটি নজরুলের বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী সত্তার এক প্রমাণ। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাকে যখন কারাগারে বন্দী করা হয়, তখন তিনি এই প্রবন্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
প্রবন্ধটির শুরুর অংশেই তিনি ঘোষণা করেন, “আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী! তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।"১ এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয় যে, তিনি কারাগারে থেকেও ব্রিটিশ শাসকদের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি তার সংগ্রামকে নিরন্তর চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
নজরুল এই প্রবন্ধে তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টের কথা উল্লেখ না করে, দেশের দুঃখ, জনগণের শোষণ এবং ব্রিটিশদের শাসননীতির প্রতি তাঁর বিদ্রোহকে প্রধান বিষয়বস্তু করেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত দেশপ্রেম হলো শাসকের শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, "আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।"২
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে এবং তাদের শোষণ করে নিজেদের সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। নজরুল বলেন, "আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃনদ দাস। এটা নির্জলা সত্য।"৩ নজরুলের মতে, ব্রিটিশ শাসন কেবলমাত্র ভারতীয়দের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়নি, বরং এটি তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিকেও ব্যাহত করেছে। এই কারণে, তিনি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি করেননি, বরং একটি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে সকল মানুষ সমান অধিকারের অধিকারী হবে।
নজরুলের দেশপ্রেমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। ব্রিটিশ শাসনভার অটুট রাখার অন্যতম কৌশল ছিলো 'Divide and Rule' বা 'ভাগ করে শাসন করা'। নজরুল মনে করতেন, ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের শাসনকে সুসংহত করছে। তাই, হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য।
নজরুল বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত দেশপ্রেম কেবলমাত্র ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হতে পারে না। তাঁর কাছে দেশের প্রতি ভালোবাসা মানে দেশের সকল জনগণের প্রতি ভালোবাসা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তাঁর লেখায় বারবার এই সাম্প্রদায়িক ঐক্যের আহ্বান প্রতিফলিত হয়েছে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'তেও তিনি এই আহ্বান জানিয়েছিলেন।
নজরুলের দেশপ্রেম ছিলো বহুমাত্রিক। তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য হলো মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা। তিনি মনে করতেন, প্রকৃত দেশপ্রেম হলো মানবতার প্রতি ভালোবাসা এবং শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করা। নজরুলের দেশপ্রেম ধর্ম, জাতি, বর্ণের ঊর্ধ্বে ছিলো, যা তাকে মানবতার কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত সাহসের সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করেছেন। নজরুলের ভাষায়, "আবার বলছি, আমার ভয় নাই, দুঃখ নাই। আমি 'অমৃতস্য পুত্রঃ'।"৪
প্রবন্ধটির প্রতিটি স্তরে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি নজরুলের ঘৃণা, ক্রোধ এবং বিদ্রোহের প্রকাশ সুস্পষ্ট। তিনি শুধু একজন লেখক বা কবি হিসেবে নয়, বরং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' ছিলো তাঁর প্রতিবাদের ভাষা, যেখানে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
নজরুলের এই প্রবন্ধের শুরু থেকেই আমরা তাঁর বিদ্রোহী মনোভাবের প্রমাণ পাই। প্রবন্ধের শিরোনামেই তিনি নিজেকে 'রাজবন্দী' হিসেবে পরিচিত করেছেন, যা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান নির্দেশ করে। এখানে তিনি শুধু একজন বন্দী নন, তিনি একজন রাজনৈতিক বন্দী, যিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশের জন্য কারারুদ্ধ হয়েছেন। নজরুল প্রবন্ধের শুরুতে ঘোষণা করেন, "আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।"৫
এই বক্তব্যের মাধ্যমে নজরুলের বিদ্রোহের মূলে যে দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার জন্য তাঁর তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ শুধুমাত্র রাজনৈতিক ছিলো না, এটি ছিলো নৈতিক ও আদর্শিক বিদ্রোহ। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসন ভারতীয়দের স্বাধীনতা, সম্মান ও অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল বারবার ব্রিটিশ শাসনের শোষণ ও অত্যাচারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনকে 'অত্যাচারী' এবং 'শোষণকারী' হিসেবে বর্ণনা করেন এবং তাদের শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার আহ্বান জানান। তিনি লিখেছেন, "আমার কণ্ঠে কাল-ভৈরবের প্রলয় তূর্য বেজে উঠেছিল, আমার হাতে ধূমকেতুর অগ্নি-নিশান দুলে উঠেছিল, সে সর্বনাশা নিশান-পুচ্ছে মন্দিরের দেবতা নটনারায়ণ রূপ ধরে ধ্বংস নাচন নেচেছিলো।"৬ নজরুলের এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, বরং এই শাসনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তাঁর মতে, ব্রিটিশরা শুধু ভারতবর্ষের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠন করেনি, তারা ভারতীয়দের মানসিকভাবে শোষণ করেছে, তাদের স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং তাদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে।
নজরুল ছিলেন এক প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চিন্তাবিদ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাম্রাজ্যবাদ মানবাধিকারের বিপরীতে কাজ করে এবং এটি মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা ও মানবতার পরিপন্থী। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, "আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচারকে দগ্ধ করবে।"৭ এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, নজরুলের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, যা মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে হরণ করে। তাঁর মতে, একটি সাম্রাজ্য তখনই টিকে থাকে, যখন তা অন্য জাতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং তাদের শোষণ করে। নজরুল এই শোষণমূলক ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন এবং ভারতীয়দের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য লড়াই করেছিলেন।
নজরুলের দেশপ্রেমের আরেকটি দিক হলো ব্রিটিশ শাসনের আইনি ও বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর অবজ্ঞা। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ আইন ও বিচারব্যবস্থা ভারতীয়দের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, "বিচারক জানে, আমি যা বলেছি, যা লিখেছি, তা ভগবানের চোখে অন্যায় নয়, ন্যায়ের এজলাসে মিথ্যা নয়। কিন্তু তবু হয়ত সে শাস্তি দেবে! কেননা, সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।"৮
তাঁর মতে, ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থা কেবলমাত্র শাসকদের সুরক্ষা প্রদান করে এবং সাধারণ জনগণের অধিকারকে খর্ব করে। নজরুল মনে করতেন, এই আইনি ব্যবস্থা ভারতের জনগণের জন্য কোনো সুরক্ষা বা ন্যায়বিচার নিয়ে আসে না, বরং এটি তাদের অধিকারের বিরুদ্ধে কাজ করে। তিনি এই বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এটি পরিবর্তনের আহ্বান জানান।
ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় সংস্কৃতিকে আঘাত করে, তাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল ব্রিটিশদের এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন। নজরুল বিশ্বাস করতেন, একটি জাতির স্বাধীনতা কেবল তার রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথেও গভীরভাবে সংযুক্ত। তিনি বলেন, "আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত।"৯
তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে নিজেদের শাসনকে সুসংহত করেছে। তাই, তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর জোর দেন। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল বলেন, "আমার কণ্ঠের ঐ প্রলয় হুঙ্কার একা আমার নয়........ কখন আমার কণ্ঠের এই হারা বাণীই তাদের আর এক জনের কণ্ঠে গর্জন করে উঠবে।"১০ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধর্মীয় বিভাজন দূর করা অপরিহার্য বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, যা ভারতীয়দের স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রধান বাধা।
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, "যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কাহারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারও পিছনে পোঁ ধরি নাই।"১১ তার এই ঘোষণা ছিল একজন স্বাধীনচেতা মানুষের কথা, যিনি কখনও শাসকের কাছে মাথানত করেননি। নজরুল বিশ্বাস করতেন, শাসকশ্রেণির শোষণ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো বিদ্রোহ ও সংগ্রাম। তাঁর লেখা কেবলমাত্র শোষণের বিরুদ্ধে নয়, বরং সমগ্র সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলো।
নজরুল তাঁর প্রবন্ধে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, "তবু জিজ্ঞাসা করছি, এই যে বিচারাসন- এ কার? রাজার না ধর্মের?....... এই বিচারককে কে পুরস্কৃত করে? রাজা না ভগবান?"১২ তার এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল রাজনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেননি, বরং তিনি একটি নতুন সমাজব্যবস্থা গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে শোষণ ও নিপীড়নের কোনো স্থান থাকবে না।
ব্রিটিশদের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতীয়দের ঐক্যকে দুর্বল করা, যাতে স্বাধীনতা আন্দোলন আরও বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের শাসন অব্যাহত থাকে। এই অবস্থায় কাজী নজরুল ইসলামের মতো প্রগতিশীল লেখক ও চিন্তাবিদদের দায়িত্ব হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ডাক দেওয়া এবং ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে একটি সম্মিলিত জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল ইসলামের ধর্মনিরপেক্ষ দেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে, যা হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের প্রতি তার দৃঢ় আস্থাকে প্রতিফলিত করে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'তে নজরুল স্পষ্টভাবে বলেন যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য অপরিহার্য। তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন শুধুমাত্র শোষকদের সুবিধা দেয় এবং সাধারণ জনগণের জন্য ক্ষতিকর। নজরুল বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত দেশপ্রেম তখনই বাস্তবায়িত হতে পারে, যখন মানুষ ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবে। তিনি বলেন, "আমার অসমাপ্ত কর্তব্য অন্যের দ্বারা সমাপ্ত হবে। সত্যের প্রকাশ-পীড়া নিরুদ্ধ হবে না।"১৩ এই বক্তব্যে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি গভীর বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। তিনি মনে করতেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধি তখনই সম্ভব, যখন হিন্দু ও মুসলমান একত্রে কাজ করবে এবং ধর্মীয় বিভেদ দূর করবে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন এক বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে—এই চিন্তা থেকেই নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে অবস্থান নেন।
নজরুল ইসলাম কখনও তাঁর রচনায় ধর্মকে অবহেলা করেননি, বরং তিনি ধর্মীয় অনুশাসনকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের অংশ হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্র বা রাজনীতি ধর্মের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তাঁর দেশপ্রেম একাধারে ধর্মনিরপেক্ষ এবং মানবতাবাদী। তাঁর কাছে দেশের প্রতি ভালোবাসা মানে দেশের প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসা, তাদের ধর্ম বা বর্ণ যাই হোক না কেন। নজরুল বলেন, "আমার বিচারককে কেহ নিযুক্ত করে নাই। এ মহা বিচারকের দৃষ্টিতে রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, সুখী-দুঃখী সকলে সমান।"১৪ এই বক্তব্যে তার মানবতাবাদী চেতনার গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নজরুল ইসলাম মনে করতেন, একজন মানুষকে তার ধর্মের চেয়ে বড় পরিচয়ে দেখা উচিত, এবং তা হলো তার মানবিকতা। তিনি মনে করতেন, মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই এবং একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন মানুষ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে অতিক্রম করে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করবে।
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ওপর। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই ঐক্যকে অপরিহার্য বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, যদি হিন্দু-মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিভেদ রেখে চলতে থাকে, তবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম কখনও সফল হবে না। নজরুল লিখেছেন, "এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়ত সত্য উদাসীন ছিল বলে। কিন্তু আজ সত্য জেগেছে, তা চক্ষুষ্মান জাগ্রত আত্মা মাত্রই বিশেষরূপে জানতে পেরেছে।"১৫ নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটিশ শাসকরা ধর্মীয় বিভাজনকে ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করছে। তাই তিনি জনগণকে আহ্বান জানান ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একত্রে কাজ করার জন্য। তাঁর মতে, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান শর্ত হলো জাতীয় ঐক্য, যা ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে গিয়ে গড়ে তুলতে হবে।
কাজী নজরুল- ইসলাম এবং হিন্দুধর্ম উভয়ের প্রতিই গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নজরুলের রচনায় আমরা দেখতে পাই, তিনি ইসলামের মূল মানবতাবাদী ও সাম্যের শিক্ষা এবং হিন্দুধর্মের আধ্যাত্মিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার লেখায় হিন্দু-মুসলমান উভয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুন্দর মেলবন্ধন দেখা যায়। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধেও নজরুল উভয় ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি ধর্মকে কখনও রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাননি। তাঁর মতে, ধর্ম মানুষের আত্মার কল্যাণের জন্য, কিন্তু এটি কখনও সামাজিক বিভাজনের কারণ হতে পারে না। নজরুল মনে করতেন, ধর্মীয় বিশ্বাস মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, এবং রাষ্ট্র বা রাজনীতি ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। নজরুল মনে করতেন যে, ধর্মের নামে যেসব বিভাজন তৈরি করা হয়, তা কেবলমাত্র শাসকদের স্বার্থে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে তিনি সরাসরি এই ধরনের বিভাজনের বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, ব্রিটিশরা কৌশলে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতীয়দের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করছে, যা স্বাধীনতার জন্য এক বড় বাধা। তিনি বলেন, "আমার এই দেহ মন্দিরে জাগ্রত দেবতার আসন বলেই তো লোকে এ মন্দিরকে পূজা করে, শ্রদ্ধা দেখায়। কিন্তু দেবতা বিদায় নিলে এ শূন্য মন্দিরের আর থাকবে কী?"১৬ এই প্রশ্নের মাধ্যমে নজরুল তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার প্রতি জনগণকে সচেতন করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মীয় ভেদাভেদ শুধুমাত্র শোষকদের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য ব্যবহৃত হয়, এবং এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব।
তিনি সব ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চেয়েছেন এবং এমন একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভাজন থাকবে না। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা এবং তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ একত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নয়, সাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
নজরুলের দেশপ্রেম ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। তার লেখায় হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ বা সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান ছিলো না। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশকে ভালোবাসতে হলে আগে মানুষকে ভালোবাসতে হবে, আর সেই ভালোবাসার মধ্যে কোনো প্রকারের ধর্মীয় বা জাতিগত বৈষম্য থাকতে পারে না। তাঁর প্রবন্ধ 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'তে তিনি এ কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। নজরুল বলেন, "আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা।"১৭ তাঁর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। নজরুলের কাছে দেশপ্রেম মানে শুধুমাত্র দেশের ভৌগোলিক সীমানাকে ভালোবাসা নয়, বরং দেশের প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসা এবং তাদের সুখ-স্বাধীনতার জন্য কাজ করা।
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর গভীর চিন্তাভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রবন্ধটি মূলত নজরুলের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করলেও, এর মধ্যে তিনি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পোষণ করেছেন, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি দেখেছেন একটি স্বাধীন, শোষণমুক্ত এবং সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতি কিংবা শ্রেণির নামে কোনো বৈষম্য থাকবে না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো প্রগতিশীল এবং মানবতাবাদী, যা শুধু ভারতের স্বাধীনতা নয়, বরং একটি সামাজিক বিপ্লবের কথাও তুলে ধরে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল ভারতবাসীর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। নজরুলের মতে, স্বাধীনতা হলো মানুষের জন্মগত অধিকার, যা কেড়ে নেওয়া যায় না। তিনি তাঁর প্রবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন যে, পরাধীনতা মানুষের মনকে শৃঙ্খলিত করে এবং তার সৃজনশীলতা ও বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দেয়। তাই, তিনি কেবল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করেই থেমে থাকেননি, বরং ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি স্বাধীন, সম্মানজনক এবং গৌরবময় ভবিষ্যৎ কামনা করেছেন।
নজরুল বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা তখনই প্রকৃত অর্থে অর্থবহ হবে, যখন ভারতীয়রা নিজেদের শাসনকাঠামো তৈরি করতে পারবে এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নিতে পারবে। তাঁর মতে, "সেই আজে না আসা রক্ত ঊষার আশা, আনন্দ - আমার কারাবাসকে হাসি গানের কলোচ্ছ্বাসে স্বর্গ করে তুলবে।"১৮ তাই তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নকে কেবলমাত্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং এটি ছিল একটি সমগ্র জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্য।
নজরুল মনে করতেন, ব্রিটিশরা শুধু রাজনৈতিকভাবে ভারতীয়দের শোষণ করেনি, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছে। তাঁর মতে, স্বাধীনতা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ শোষণমুক্ত হবে এবং নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে পারবে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল বলেন, "সে যাহার সৃষ্টি, তাহাকেই সে বন্দি করতে চায়, শাস্তি দিতে চায়! কিন্তু অহংকার একদিন চোখের জলে ডুববেই ডুববে!"১৯ এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, নজরুল রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার ওপরও জোর দিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন এক সমাজের, যেখানে মানুষকে ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণির ভিত্তিতে শোষণ করা হবে না এবং সবাই সমান সুযোগ পাবে।
নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করা উচিত নয়, বরং তাদের একত্রিত করতে হবে। তাঁর মতে, ধর্মের নামে হানাহানি আমাদের সমাজের ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। যদি আমরা সত্যিই একটি স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে চাই, তবে আমাদের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। নজরুল ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবতাবাদ ও সাম্যবাদী চেতনার প্রতিফলন স্পষ্ট। তিনি কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেননি, বরং এমন এক সমাজের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ সমান হবে এবং শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান ঘটবে। তাঁর মতে, মানুষের প্রকৃত উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন সমাজে ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এটি একসময় না একসময় হবেই। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি'তে নজরুল বলেন, "সত্য স্বয়ং প্রকাশ। তাহাকে কোনো রক্তআঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না।"২১
নজরুল ইসলাম শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি মনে করতেন, একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি তখনই সম্ভব, যখন সেই জাতির প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হবে এবং তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে বলেন, "কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন।"২২ নজরুলের মতে, শিক্ষা শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান নয়, বরং এটি মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার উন্নতির জন্য অপরিহার্য। তিনি একটি এমন শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা মানুষকে কেবলমাত্র চাকরির জন্য প্রস্তুত করবে না, বরং তাদের মধ্যে নৈতিকতা, মানবিকতা এবং দেশপ্রেম জাগ্রত করবে।
'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে নজরুল তাঁর ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, "আমার বন্দিনী মায়ের আঁধার-শান্ত কোল এ অকৃতী পুত্রকে ডাক দিয়েছে।"২৩ তাঁর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে তুচ্ছ করেছেন এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। নজরুলের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি শুধু একজন কবি বা লেখক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সংগ্রামী, যিনি তাঁর কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং তাঁর দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই প্রবন্ধে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। তাঁর সাহসী লেখনী ও দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা তাকে বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' প্রবন্ধটি শুধু তাঁর দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়, এটি একটি স্বাধীন, সাম্যবাদী ও শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি, যা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাছাড়া এ প্রবন্ধটি একটি সাহসী ও বিদ্রোহী মনোভাবের প্রতিফলন, যেখানে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন। এটি শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দলিল, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
তথ্যসূত্র:
১। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
২। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৪
৩। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৫
৪। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৭
৫। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
৬। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৬
৭। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৭
৮। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৫
৯। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
১০। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৫
১১। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৬
১২। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৫
১৩। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৭
১৪। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
১৫। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৫
১৬। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৬
১৭। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৬
১৮। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৬
১৯। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৪
২০। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা:
২১। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
২২। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৩
২৩। স্নাতক বাংলা জাতীয় ভাষা - বাংলা সাহিত্য সংগ্রহ পরিষদ সম্পাদিত, মার্চ ২০২০ সংস্করণ: রাজবন্দীর জবানবন্দি - কাজী নজরুল ইসলাম - পৃষ্ঠা: ৮৭