বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্পে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ

বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্পে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ

আসিফ করিম শিমুল


বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বিভূূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার মুরারিপুর গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত দারিদ্র্যতার মধ্যে তিনি বাল্য ও কৈশরকাল অতিবাহিত করেছেন। ব্যক্তিজীবনের দারিদ্র্যতার প্রভাব তাঁর সাহিত্যকর্মেও প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষকরে দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রাম্য জনপদের চিত্র তাঁর সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। শুধু দারিদ্র্যতা নয়, সমসাময়িক সামাজিক সম্পর্ক, গ্রামীণ কুসংস্কার, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের আর্থিক অবস্থান সবকিছু চমৎকার ভাষা মাধুর্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বিভূতিভূষণের গল্প ও উপন্যাসের মূল উপজীব্য দারিদ্র্য-পীড়িত গ্রামের মানুষের সহজসরল জীবনধারার প্রতিফলন। তবে এর পাশাপাশি লেখকের অন্য যে দর্শন বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি হলো অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার মনোভাব।

বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্পে অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ


বিভূতিভূষণের অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে 'আহ্বান’ গল্পটি অন্যতম। আহ্বান গল্পটি লেখকের নবম গল্পগ্রন্থ ‘উপলখণ্ড’ (১৯৪৫) এর অন্তর্গত। এটি একটি উদার মানবিক সম্পর্কের গল্প। স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রীতির বন্ধন যে ধনসম্পদেরও অনেক উর্ধ্বে তা আহ্বান গল্পটি পড়লেই আরো স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। স্নেহের এই বন্ধন গড়ে ওঠে মূলত হৃদয়ের নিবিড় আন্তরিকতার স্পর্শে। এখানে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, ধর্মীয় দূরত্ব, সংস্কার, গোড়ামি কোনো বাঁধা মানে না। আহ্বান গল্পে লেখক মাতৃ স্নেহের যে নজির উপস্থাপন করেছেন তা এই বিষয়েরই ইঙ্গিতবাহী।


আমাদের সমাজে শ্রেণি বৈষম্য একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেকড় গেড়ে বসেছে। বিশেষকরে হিন্দু এবং মুসলিম এই দুটি সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব যেন কোনো কালেই ঠিক হবার নয়। হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের বহু চিত্র ইতিহাসে বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান আলাদাও হয়ে গেলো। বহু সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে এই দ্বন্দ্বের করুণ পরিণতি পরিলক্ষিত হয়। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে অনেক সাহিত্যিক নিজস্ব ভাবনায় নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৩৬) তে হোসেন মিয়ার যে ময়নাদ্বীপ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটি মূলত অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠারই একটি প্রচেষ্টা। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), লালন শাহ (মৃত্যু ১৮৯০) এমনিভাবে বহু সাধক এমনকী স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও (১৯২০-১৯৭৫) অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর বিভিন্ন রচনায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত করেছেন। ‘আহ্বান’ তেমনি এক অসাম্প্রদায়িক চেতনাবাহী উৎকৃষ্টমানের ছোটগল্প। আহ্বান গল্পের প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র দুটির নির্দিষ্ট নাম লেখক নির্ধারণ করেননি। তবে গল্পের বর্ণনায়, ভাষা ভঙ্গিমায় এবং কথোপকথোনে স্পষ্টভাবে দুটি ভিন্ন ধর্মকে নির্দিষ্ট করা যায়। গল্পে মাতৃস্নেহের অধিশ্বর হিসেবে যে বুড়িকে দেখানো হয়েছে তার নির্দিষ্ট নাম নেই ঠিকই, কিন্তু স্বামীর নাম উল্লেখ আছে ‘জমির করাতি’। লেখক অবশ্য তাকে বুড়ি বলেই সম্বধোন করেছেন। অপরদিকে অন্য প্রধান চরিত্র বা গল্প কথক যিনি লেখক তারও সুনির্দিষ্ট কোনো নাম দেননি। বুড়ি মাতৃস্নেহে তাকে ‘গোপাল’ বলে ডেকেছেন। স্বভাবতই বোঝা যায়, বুড়ি ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং গোপাল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। লেখক এই দুই ধর্মের একটা মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন এই গল্পে যেটা তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রতিফলিত করে।


এটা স্পষ্ট যে, লেখক চাইলেই প্রধান দুটি চরিত্রের উভয়কে হিন্দু বা উভয়কে মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সচেতনভাবেই সেটা করেননি। অবশ্য এখানে অন্য একটি কারণও লক্ষণীয়। মাতৃস্নেহ চিরন্তন। মাতৃস্নেহ ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-গোত্র কোনো ভেদাভেদ মানে না। তবে গল্পের শেষটায় বোঝা যায় মাতৃস্নেহকে ছাপিয়ে লেখকের অসাম্প্রদায়িক চেতনাটাই বড় হয়ে উঠেছে।


একুশ শতকে এসে আমরা অনেকটা আধুনিক হয়েছি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই রক্ষণশীল মনোভাবটা কিছুটা হলেও কমেছে। এপ্রসঙ্গে ব্যক্তিজীবনের একটি ঘটনা মনে পড়ে। ছোটবেলায় এক হিন্দু বাড়িতে প্রাইভেট পড়তাম। আমার জন্য বারান্দার এক কোণে জায়গা নির্দিষ্ট ছিল। পড়া শেষ হলেই দেখতাম সেই বাড়ির মহিলা আমার বসার স্থান সহ যে পথে উঠেছি এবং নেমেছি সেই পথও তাদের নির্দিষ্ট ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দিয়ে পবিত্র করতেন। সেখানে গল্পের বুড়ি অনায়াসে গোপালের বাড়িতে এসেছেন, বসেছেন আবার গোপালও বুড়ির বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ বুড়ির পাশে খেজুর পাতার চাটাইয়ে বসেছেন। বাবা দাদাদের মুখে গল্প শুনেছি তাদের ছোটবেলায় কোনো হিন্দু-মুসলিম মুখোমুখি হতো না, কেউ কারও হাতের কিছু গ্রহণও করতো না, খাওয়া তো অনেক দূরের কথা। তাহলে ১৯৪৫ সাল বা তারও আগে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতা আরও কতটা ভয়াবহ ছিল সেটা যে-কেউ অনুমান করতে পারবেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মাতৃস্নেহের আড়ালে এক মুসলিম বৃদ্ধার হাত দিয়ে এক হিন্দু ছেলের কাছে আম, দুধ, কচি শশার জালি, পাতিলেবু, কাঁচকলা, কুমড়ো প্রভৃতি উপহার পাঠিয়েছেন এবং হিন্দু ছেলেটিও সেগুলি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। হিন্দু-মুসলিম এই দেওয়া-নেওয়া সম্পর্কটা তৎকালিন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ছিল বলেই অনুমেয়। লেখকের যদি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব না থাকতো তাহলে তিনি এটি ঘটাতে পারতেন না।


শুধু দেওয়া-থোওয়া নয়, দাফন-কাফন কিংবা মৃতের সৎকারে আধুনিক সময়ে এসেও হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্ষণশীলতা রয়ে গেছে। এখনও পর্যন্ত কোনো মুসলিমের দাফন-কাফনে কোনো হিন্দুকে দেখা যায় না, আবার কোনো হিন্দুর সৎকার কাজেও মুসলিমদের দেখা যায় না। দেখা গেলেও খুবই সীমিত। সেখানে বিভূতিভূষণ দেখিয়েছেন অন্য কিছু। গল্পের প্রধান চরিত্র বুড়ি মারা গেলে অন্য প্রধান চরিত্র গোপাল বুড়ির জন্য কাফনের কাপড় কিনে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কবরে মাটি দেওয়ার সময় গোপালও নিজ হাতে এক কোদাল মাটি দিয়েছে। একজন মুসলিমের দাফনে হিন্দু ছেলেকে টেনে আনা ১৯৪৫ সালের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক বড় সাহসিকতার কাজ ছিল বলেই মনে হয়।


গল্পের অন্তিমে লেখক দেখিয়েছেন এক মায়ের স্নেহাতুর আত্মা বহুদূর থেকে তার দাফনের জন্য সন্তানকে আহ্বান করে এনেছে। কিন্তু আমার মনে হয় লেখক এই ঘটনার আড়ালে অন্য কিছু দেখিয়েছেন। কেননা, সাম্প্রদায়িকতার মহা প্রলয় (১৯৪৭ সালের দেশভাগের ঘটনা) যে চরম মাত্রা ধারণ করছিলো হয়তো দূরদর্শী এই লেখক সেটা আগে থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাইতো তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয়কেই আহ্বান করলেন, এসো তোমরা সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত ভুলে এক হও, মিলে মিশে অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করো।


২০-০৩-২০২৪ ইং

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post